সোহাগ-শাসন আদর-বাদর এবং বর্তমান

 

শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি অবশ্যই অভিভাবকদের জন্য চরম উদ্বেগের বিষয়। কেননা, সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে হলে শাসন অনিবার্য। সকল পিতা মাতাই তোর সন্তানের ভালো চায়। আর তাতেই যদি দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে উপায়? যদিও শাসন মানে মারপিট বা ঘরে বন্দি করে নির্যাতন নয়।

সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই বদলায়। কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় অনেক পদ্ধতি, নিয়ম কানুন। একসময় মাস্টারমশাইর বেত্রাঘাতকে আর্শিবাদ মনে করা হলেও এখন তা অপরাধ। মারা দূরের কথা বেত বা বড় দাগকাঠি নিয়েও এখন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের সুযোগ নেই। নানাভাবেই পরীক্ষিত, শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাতে বা চোখ রাঙিয়ে মুখস্ত বিদ্যাদানের চেয়ে পাঠগ্রহণে মনোনীবেশ করতে পারাই দক্ষতা। শিক্ষকমণ্ডলীকে সেভাবেই দক্ষতা মেলে ধরার জন্য যোগ্য করার চেষ্টা চলছে। আর সন্তানকে সুপথে রেখে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে অভিভাবকের দায়িত্ব? সবার ওপর। ঘুরে ফিরেই বলা হচ্ছে, প্রত্যেক শিশুর মূল শিক্ষালয় তার বাড়ি। বাড়ির বড়রাই শিশুদের পথ বাতলে দেন, মানসিক বিকাশ ঘটানোর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সোপান বা মই হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে কারণে প্রাপ্ত বয়সীদের যা কিছু উপভোগ্য তা অপ্রাপ্তদের আড়াল করাই শ্রেয়। বড়দের আচরণ উল্টো পাল্টা হলে ছোটদের নিকট থেকে যেমন ভালো কিছু আশা করা অবান্তর তেমনই ওদের বেড়ে ওঠার পথে সোপান হিসেবে দায়িত্ব পালনে গড়িমসি তথা উদাসীন হলে প্রত্যাশার উল্টো ফলটাই মেলে। সেটাই কি হওয়া উচিত নয়? তবে হ্যাঁ, সমস্যা একটি রয়েছে, তাহলো বড় আর ছোটদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান। স্থান দূরত্বে যেমন ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতির তফাত রয়েছে, তেমনই বয়সের ব্যবধানে মানসিকতারও ফারাক কম নয়। ওই ব্যবধান কমিয়ে ক’জন অভিভাবকই আর পারছেন সন্তানকে চোখে চোখে রেখে বন্ধুসুলভ আচরণের মধ্যদিয়ে কঠোর অধ্যাবসায়ের গণ্ডিতে রাখতে? না, কাজটি কঠিন নয়। বড়দেরই উচিত ওদের মন বুঝে বর্তমানকে মনে রেখে বোঝা চাপানো।

না, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। কোনো প্রতিবাদের ভাষাও নয়। তারপরও কেন আত্মহত্যা? শুধুই কি অসহনীয় শাসন? অবশ্যই না। আত্মহত্যা সমাজের একরধরনে রোগ। ক্ষতিকর প্রবণতা। এ প্রবণতা রোধে আমাদের সমাজ যেমন উপযুক্ত পদক্ষেপে ব্যর্থ, তেমনই অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে যথেষ্ট অসচেতনতা। এর দায়ও সমাজের ওপরই বর্তায়। চুয়াডাঙ্গা জীবননগরের এক স্কুলছাত্রের আত্মহত্যার বিষয়ে নানা মত থাকতে পারে। তবে শাসনের মাত্রা যে অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো, আত্মহত্যা প্রবণতা পেয়ে বসেছিলো তা অস্বীকার করার জো নেই। সমাজের ওরকম আর একটি কুড়িকেও আমরা ঝরাতে চাই না। ঝরে পড়ুক তা কাম্য নয়। সে কারণেই সমাজের সচেতন মহলকে সর্বপ্রথম সচেতনতার আলো ছড়ানোর দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হতে হবে। প্রতিটি আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ উন্মোচন করে তা রোধে আইনগত ও সামাজিক পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় আত্মহত্যার মতো ভয়ানক ক্ষতিকর প্রবণতার হিংস্র আগুনের ফুলকি কখন কার ঘরে কীভাবে পৌঁছে যাবে তা আগাম বলা সত্যিই কঠিন। কেননা, কালের বিবর্তনে  সময়ের স্রোত তীব্রতর হয়ে উঠেছে। আকাশ সংস্কৃতি তথা ইথারে ভাসা যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রজন্মকে যতোটা এগিয়ে দিচ্ছে বড়রা তার তাল সামলাতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ছে। জীবনপ্রবাহে অভিভাবকদের প্রতি কদমেই যেন আচমকা বাঁক। সামান্য পা হড়কালেই সর্বনাশ।

লেখাপড়ায় নিজের অপরাগতা বা ব্যর্থতাকে সন্তানের মাধ্যমে সফলতা বা অর্জনের স্বপ্ন দেখা নিশ্চয় অন্যায় নয়। অন্যায় হয় তখনই যখন পরিবার, পরিবেশ এবং বর্তমানকে অস্বীকার করা হয়। সত্যিই অভিভাবকেরা বর্তমানের কাছে ব্ড্ড অসহায়। চরম এই সত্যকে প্রাণপ্রিয় সন্তানদের বোঝানোটাই দায়। সন্তানের ভালো কে না চান?

প্রনশ্চ: শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে গো।