যশোরের সাবেক এমপি সাখাওয়াতের মৃত্যুদণ্ড : ৭ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়

 

স্টাফ রিপোর্টার: মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যশোরের সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার বাকি ৭ আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এরা হলেন- বিল্লাল হোসেন বিশ্বাস, ইব্রাহিম হোসাইন, শেখ মজিবুর রহমান, এম এ আজিজ সরদার, আব্দুল আজিজ সরদার, কাজী ওহিদুল ইসলাম ও আব্দুল খালেক। সাখাওয়াত ও বিল্লাল হোসেন ছাড়া বাকি ৬ আসামি পলাতক রয়েছেন। গতকাল বুধবার বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় দেন। রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ৫ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা গুলি করে আসামি সাখাওয়াতের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে।

ট্রাইব্যুনালের অপর ২ সদস্য হলেন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী। রায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম একই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তবে অপর বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী আলাদা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। তবে ৩ বিচারপতির সর্বসম্মতিতে আসামিদের সাজা প্রদান করা হয়েছে।

এদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। শহীদ পরিবারগুলো রায়ে স্বস্তি পাবে। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর বাকি সাতজনের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করা হবে কি-না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি জানান। তবে কারাবন্দী ২ আসামির আইনজীবী আব্দুস সাত্তার জানান, তারা রায়ে সন্তুষ্ট নন। পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে আসামির সঙ্গে পরামর্শ করে তারা আপিল করবেন। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক রায় ঘোষণা করেন। এর আগে ৭৬৮ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপ পড়েন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম। এ সময় ২ আসামিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। রায়কে ঘিরে বরাবরের মতোই ট্রাইব্যুনাল এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।

মামলার প্রথম অভিযোগে ৪ জন, দ্বিতীয় অভিযোগে ৮ জন, তৃতীয় অভিযোগে ৪ জন, চতুর্থ অভিযোগে ৫ জন এবং পঞ্চম অভিযোগে ৬ জন আসামি ছিলেন। যশোরের কেশবপুর উপজেলার চিংড়া গ্রামের চাঁদতুল্য গাজী ও তার ছেলে আতিয়ারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার দ্বিতীয় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রধান আসামি সাখাওয়াতকে মৃত্যুদণ্ড ও বাকি ৭ জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

কেশবপুরের হিজলডাঙার আ. মালেক সরদারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও খুনের চার নম্বর অভিযোগও প্রমাণিত হওয়ায় সাখাওয়াতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগের অপর চার আসামি ইব্রাহিম হোসাইন, এম এ আজিজ সরদার, আব্দুল আজিজ সরদার ও আব্দুল খালেক মোড়লকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

এক, তিন ও পাঁচ নম্বর অভিযোগে আসামিদের যথাক্রমে ২০, ১০ ও ১৫ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে তিন নম্বর অভিযোগ থেকে আসামি ইব্রাহিমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কেশবপুর উপজেলার বোগা গ্রামে এক নারীকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ধর্ষণের এক নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আসামি সাখাওয়াত হোসেন, ইব্রাহিম হোসাইন, এম এ আজিজ সরদার ও আব্দুল আজিজ সরদারকে পৃথকভাবে ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। চিংড়া গ্রামের মো. নূরুদ্দিন মোড়লকে অপহরণ, আটক, নির্যাতনের তিন অভিযোগে সাখাওয়াত, মজিবুর রহমান ও খালেক মোড়লকে পৃথকভাবে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া মহাদেবপুর গ্রামের মিরন শেখকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ওই গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের পাঁচ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় সাখাওয়াত, ইব্রাহিম, এম এ আজিজ, আব্দুল আজিজ সরদার ও খালেক মোড়লকে পৃথকভাবে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের একইসঙ্গে এ সাজা ভোগ করতে হবে। আর সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে অন্য সাজা স্বাভাবিক কারণেই একীভূত হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, মামলার প্রধান আসামি সাখাওয়াত এক সময় ছিলেন জামায়াত নেতা। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামী থেকে নির্বাচন করে যশোর-৬ আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হন। তবে মেয়াদপূর্তির আগেই জামায়াত ছেড়ে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন সাখাওয়াত। এর পর বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে। পরে বিভিন্ন সময়ে এলডিপি ও পিডিপিতে ঘুরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন তিনি। সাখাওয়াত হোসেনকে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয়।

যুদ্ধাহত মিরনকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়ার নির্দেশ: ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারদের গুলিতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যদাতা মিরন শেখকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যশোরের কেশবপুরের মহাদেবপুর গ্রামের জোবেদ আলী শেখের ছেলে যুদ্ধাহত মিরন শেখ বর্তমানে ভিক্ষার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

মামলার পূর্বাপর: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যশোরে আসামিদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলে সেগুলো ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাখাওয়াতসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর আদালত নয়জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়। ‘অভিযোগের উপাদান’ না পাওয়ায় ৩ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয় ট্রাইব্যুনাল। যুদ্ধাপরাধের পাঁচ অভিযোগে গত বছর ২৩ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে ৯ জনের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে একজন বিচার চলাকালীন মারা গেলে ৮ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়।

ফাঁসি দ্রুত কার্যকরের দাবি: যুদ্ধাপরাধী মাওলানা সাখাওয়াতের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে যশোরবাসী। এর মধ্য দিয়ে কলঙ্ক মোচন হবে বলে মনে করছেন মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় এলাকাবাসী, আইনজীবী ও গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃবৃন্দ। এদিকে ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই  জেলায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।

জেলা গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক কাজী আবদুস শহীদ লাল বলেন, এটি যুগান্তকারী রায়। তবে অবিলম্বে সাজা কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি। একই দাবি জানিয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার রাজেক আহমেদ বলেন, ফাঁসির রায়ে যশোরবাসী আনন্দিত।

এ রায়ে সাখাওয়াত হোসেনের নিজ গ্রাম হিজলডাঙ্গাসহ উপজেলাব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনতা উল্লাস প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। উপজেলার প্রবীণ সাংবাদিক আজিজুর রহমান বলেন, এ রায়ের ফলে বাঙালি জাতি শহীদদের ঋণ কিছুটা হলেও পরিশোধ করতে পারলো। উপজেলার চিংড়া গ্রামের শহীদ চাঁদতুল্য গাজীর ছেলে গাজীউর রহমান বলেন, সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে রাজাকাররা আমার পিতা চাঁদতুল্য ও ভাই আতিয়ারকে হত্যা করেছে। এ রায়ে আমাদের পরিবারসহ এলাকাবাসী অত্যন্ত খুশি। তিনিও অবিলম্বে এ রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন।

Leave a comment