চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুরে বিদ্যুত বিভাগের বেহালদশা : গ্রহণ ও বিতরণ লাইনের ত্রুটি নিয়ে লাইনম্যানদের নাকানি চুবানি
মাথাভাঙ্গা ডেস্ক: চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ সারাদেশে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। আজও বৃষ্টি হবে। বিকেলের পর পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। বর্ষার শেষভাগে নিম্নচাপের প্রভাবে এ বৃষ্টিতে যশোরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চুয়াডাঙ্গায়? অতোটা না হলেও বিদ্যুত বিতরণের বেহাল দশা ফুটে ওঠেছে। গতকাল দুপুরে বন্ধের পর চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে বিদ্যুত সরবরাহ চালু করতে লেগেছে বহু সময়। গতরাত ১টার কিছুক্ষণ আগে থেকে একে একে ফিডারগুলোতে বিদ্যুত সরবরাহ চালু হয়। অবশ্য তার আগে বিদ্যুত দিয়ে চেক করতে গিয়ে ট্রিপ করার কারণে ত্রুটি শনাক্তের কাজে বেরাতে হয় লাইনম্যানদের। এদিকে বিদ্যুত না পেয়ে গ্রাহক সাধরণ ক্ষোভে ফুঁসেছেন। গ্রাহকদের অনেকেই বলেছেন, সাবগ্রিড স্টেশনটি জাফরপুরে। আর বিতরণ কেন্দ্রটি চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের একাডেমি মোড়ের অদূরে। অতোটুকু দূরুত্বের ইনকামিং ফল্ট খুঁজে মেরামত করতেই লেগে গেলো ৭ ঘণ্টা? তা ছাড়া বিদ্যুত বিতরণ স্বাভাবিক রাখতে প্রতিবছরই তো গাছের ডাল কাটার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এরপরও সামান্য ঝড়ো বাতাসে ডাল কোথা থেকে এসে তারের ওপর পড়ে বিদ্যুত সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে? ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের এসব প্রশ্নের সোজা সাপ্টা জবাব, যখন যে বরাদ্দ মেলে তখন তা দিয়ে কাজ করা হয়। গাছের ডাল অতো বাড়লে কীভাবে পারা যায়? তা ছাড়া বর্ষা শেষে আবার ঝাপোট এসে ঝামেলা বাধাবে কে জানে? এরকম জবাবে রশিক গ্রাহকের মন্তব্য, কর্তব্যরতরা কষ্ট করে বিদ্যুত দিচ্ছে সেটাই তো অনেক বড়। কোন বিভাগের লোকজন রাতে বৃষ্টিতে ভিজে গ্রাহকদের স্বস্তি দিতে অতোটা আন্তরিকভাবে কাজ করেন? সব দোষ নন্দঘোষের মতো বিদ্যুত বিভাগের ওপর দোষ চাপানোর আগে বিতরণ ব্যবস্থা কেন আধুনিকায়ন করা হয় না?
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় অঞ্চলে নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের মাত্রা সব সময়ই বেশি থাকে। গতকালও ছিলো তাই। এই বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর এবং নৌবন্দরগুলোকে ২ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর আরও জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেলের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। নিম্নচাপটি গতকাল বুধবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে যশোর-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে অবস্থান করে। এর প্রভাবে আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। নিম্নচাপটি খুব ধীরে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ তথ্য জানিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, দুপুর থেকে ঢাকাসহ দেশের মধ্যাঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। নিম্নচাপটি উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকেলের পর এটি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে যাবে। এর আগ পর্যন্ত বৃষ্টি খুব একটা কমবে না। বুধবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পর্যন্ত যশোরে ২৪০, চুয়াডাঙ্গায় ৮০, কুতুবদিয়ায় ৯৪, চট্টগ্রামে ৬৮, সাতক্ষীরায় ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ‘রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে।’ উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগড়ব গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থানরত লঘুচাপটি ঘণীভূত হয়ে উপকূলীয় গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
গতকাল দুপুরের পর চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায। কেন? ওজোপাডিকোর চুয়াডাঙ্গা অনুসন্ধানে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, ইনকামিঙে ফল্ট। সংশ্লিষ্টরা ত্রুটি শনাক্ত করার কাজ শুরু করেছেন। বৃষ্টির কারণে স্বাভাবিকভাবে কাজ করা যাচ্ছে না। সে কারণে কখন ত্রুটি মেরামত করে বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক করা হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। রাত ১০টার দিকে ইনকামিং ফল্ট মেরামত করে বিতরণ কেন্দ্র পর্যন্ত বিদ্যুত নেয়া হলেও বিতরণে ফিডারগুলোর ত্রুটি ভয়াবহ হয়ে দেখা দেয়। হাতে গোনা কয়েকজন লাইনম্যানকে বৃষ্টিতে কাকভেজা ভিজে কাজ করতে হয়েছে।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মেহেরপুর জেলায় গতকাল বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুত পাওয়া গেলেও সাথে সাথেই বিভ্রাটের শিকার হচ্ছে। সকাল থেকে বিদ্যুত না পাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো। মিল কারখানাও বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুত বিভাগ বলেছে- মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে গাছ ভেঙে পড়েছে। তাছাড়াও ঝড়ো বাতাস হওয়ার কারণে ডালপালা ভেঙে পড়ছে বিদ্যুত লাইনের তারের ওপর। ফলে বিদ্যুত দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গতরাত থেকেই মেহেরপুরের ওপর দিয়ে দমকা হাওয়া ও থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত আবহাওয়া স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকেই চলছে দমকা হাওয়া ও থেমে থেমে বৃষ্টি। এরপর থেকেই জেলায় বিদ্যুত বিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এদিকে সারা দিন বিদ্যুত বিহীন থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ, অফিস আদালত, মিল কারখানা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুত না থাকায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বিকল্প উপায়ে জেনারেটর চালিয়ে সেবা দিতে হচ্ছে তাদের। রাত ১১টার দিকে একবার বিদ্যুতের মুখ দেখা গেলেও তা স্থায়ী হয় মাত্র এক মিনিট।
মেহেরপুর রাবেয়া মেডিকেল সার্ভিসের সত্বাধিকারী মুকুল বাশার জানান, তার একটি ল্যাব ও ক্লিনিক রয়েছে। বিদ্যুত না থাকার কারণে সকাল থেকে বিকল্প উপায়ে অর্থাৎ জেনারেটর চালিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে খরচ হচ্ছে দ্বিগুন। আবার অনেক সময় সময়মতো রিপোর্টগুলো সরবরাহ করতে পারছেন না।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. বিপুর কুমার বিশ্বাস জানান, তারা হাসপাতালের রোগী দেখা শেষ করে দুপুর সাড়ে ১২টার পর থেকে অপারেশন শুরু করেন। কিন্তু বিদ্যুত না থাকার কারণে কোনো অপারেশনই তারা করতে পারেননি। অনেক প্রসূতি রগীকে বাইরের বিভিন্ন ক্লিনিকে অপারেশন করতে হয়েছে। ফলে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন তারা। এদিকে বিকল্প উপায়ে হাসপাতালের জেনারেটর চালিয়ে অপারেশন করবেন কিন্তু বিকল থাকার কারণে সেটাও সম্ভভ হয়নি।
মেহেরপুর শহরের মিল মালিক বাবু জানান, বিদ্যুত না থাকার করণে মিলে ধান, চাল, গম, ভুট্টা কিছুই পিশাই করতে পারনেনি। ফলে কোনো টাকা রোজগার না করে শুন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে।
মেহেরপুর ওজোপাডিকোর সহকারী প্রকৌশলী খশরুল ইসলাম জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারো হাত নেয়। দমকা হাওয়ার কারণে রাস্তায় অনেক গাছ ভেঙে পড়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় তারও ছিড়ে গেছে। ফলে বিদ্যুত দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে তারা নিরবিচ্ছন্ন কাজ করে যাচ্ছেন। দমকা হাওয়া কমে গেলে আবারো বিদ্যুত চালু কারা সম্ভব হবে।
ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা জানিয়েছেন, দামুড়হুদা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় আরও ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখীন হবে বলে ভুক্তভোগী মহল আশঙ্কা করছে। দ্রতপানি নিষ্কাশনে পাকা ড্রেন নির্মাণের জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিকট দাবি জানিয়েছেন পানিবন্দি মানুষ। সরজমিনে কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের মাঝপাড়া, কাস্টমমোড, কলোনিপাড়া, কবরস্থান পাড়া, আরামডাঙ্গা, সুবলপুর কাঞ্চনতলা, কোমরপুর গ্রামের মাঝপাড়া, বাঘাডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় বহু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়ি থেকে বাইরে আসতে পারছে না। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে আসা যাওয়া করতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। পানিবন্দি পরিবারগুল দ্রত পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন নির্মাণের দাবি জানিয়েছে।
আন্দুলবাড়িয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, টানা ১৬ ঘণ্টার অবিরাম বর্ষণে জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নের মাঠঘাট তলিয়ে গেছে। কাঁচা ও আধাপাকা ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। আন্দুলবাড়িয়া-সন্তোষপুর সড়কে ও আন্দুলবাড়িয়া-সরোজগজ্ঞ সড়কসহ বিভিন্ন গ্রামীণ সড়কে গাছপালা উপুড়ে পড়ে সকল যানবহন চলাচল ব্যহত হয়ে পড়েছে। অনেকে পানিবন্দি হয়ে পড়ায় পাকা ও কাঁচা সড়ক কেটে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে দেখা গেছে।
ট্রেনযাত্রীদের বরাত দিয়ে জানা গেছে, রেলপথের বিভিন্ন স্থানে গাছপালা উপুড়ে পড়ে ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে সকল ট্রেন বিলম্বে চলাচল করছে। মাঠের উঠতি ফসলাদি কলা, বেগুন, করলা, সিম, লাউ, বরবটি, ঝাল, পেঁপে, ধান, পাটসহ বিভিন্ন অর্থকারী ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্থনে ফসলাদি ডুবে গেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তাতক্ষণিকভাবে নিরাপণ করা সম্ভব হয়নি। স্বরণকালের ভয়াবহ টানা বর্ষণে বিদুত ব্যবস্থা কার্যত সকাল থেকে অচল হয়ে পড়েছে। ইউনিয়নের বিভিন্ন হাট বাজারের দোকানপাট সন্ধ্যার পর বন্ধ হয়ে গেছে। বিদুত না থাকায় ভুতড়ে এলাকায় পরিণত হয়েছে।
পাটুরিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মেঘমালার প্রভাবে পদ্মা নদীতে সৃষ্ট ঢেউয়ের কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে কর্তৃপক্ষ এ নৌপথে চলাচলকারী ২৫টি লঞ্চ বন্ধ করে দেয়। ফলে লঞ্চের যাত্রীরা ফেরিতে পার হচ্ছেন। দৌলতদিয়ার ৪টি ঘাটের মধ্যে দুটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় ৬টি ছোট ও মাঝারি ফেরি দিয়ে সীমিত আকারে ছোট যানবাহন পার করা হচ্ছে। লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় ঘাটে আসা শ শ যাত্রী ওই ফেরি দিয়ে নদী পার হচ্ছেন। বিআইডব্লিউটিসি আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান জানান, লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় হালকা যানবাহনের পাশাপাশি প্রতিটি ফেরিতে ২৫০-৩০০ যাত্রী পার হচ্ছেন।