১৬ বছরের অনশন শেষ

মাথাভাঙ্গা মনিটর: বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম অনশন শেষ হয়ে গেলো মঙ্গলবার। আফস্পার বিরুদ্ধে টানা ১৬ বছর লড়াই চালানোর পর অনশন আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন ইরম চানু শর্মিলা। মধু খেয়ে অনশন ভাঙলেন ‘আয়রন লেডি অব মণিপুর’। তবে চোখের জল বাঁধ মানলো না আর। বললেন, ‘এই মুহূর্তটা কোনো দিন ভুলবো না।’ একই সাথে জানিয়ে দিলেন, পরবর্তী লক্ষ্য মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া।

ইম্ফলের একটি হাসপাতালেই বন্দি রাখা হয়েছিলো শর্মিলাকে। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর ইম্ফলের কাছেই একটি গ্রামে গুলি চালায় আসাম রাইফেলস। মহিলা ও শিশুসহ ১০ সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয় তাতে। গোটা মণিপুর প্রতিবাদে উত্তাল হয়। কিন্তু আসাম রাইফেলসের যে জওয়ানরা গুলি চালিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিলো না। কারণ জঙ্গি উপদ্রুত মণিপুরে সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বা আফস্পা বলবৎ। ওই আইনে সশস্ত্র বাহিনীর গুলিচালনার ওপর বিধিনিষেধ প্রায় নেই বললেই চলে। আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরেই আন্দোলন চলছিলো মণিপুরে। ২০০০ সালের ঘটনার পর তা আরও তীব্র হয়। সমাজকর্মী তথা কবি ইরম চানু শর্মিলা নিজের মতো করে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেন। ৫ নভেম্বর থেকে তিনি অনশন শুরু করেন আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে। গ্রেফতার করে নেয়া হয়েছিলো তাকে। পুলিশ হেফাজতেও তাকে খাওয়ানো সম্ভব না হওয়ায় তাকে বলপূর্বক নাকে নল ঢুকিয়ে তরল খাবার দেয়া শুরু হয়। আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে মামলা শুরু হয় তার বিরুদ্ধে। সেই থেকে মূলত বিচারবিভাগীয় হেফাজতেই ছিলেন শর্মিলা। কিন্তু অনশনের সিদ্ধান্তে অনড়ই ছিলেন। ইম্ফলের সরকারি হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডেই বন্দি রাখা হয়েছিলো তাকে। নাকে নল দিয়ে তরল খাবার দেয়া চলছিলো। ৫ হাজার ৭৫৭ দিন এ ভাবেই লড়াই করলেন ইরম চানু শর্মিলা। ২৮ বছর বয়সে শুরু হওয়া সেই লড়াই থামলো ৪৪ বছর বয়সে পৌঁছে ১৬ বছর কাটিয়ে। তবে শর্মিলা বলছেন লড়াই থামেনি। লড়াই এবার অন্য পদ্ধতিতে।

সরাসরি রাজনীতিতে নামছেন ইরম চানু শর্মিলা। আগেই জানিয়েছিলেন সে কথা। গতকাল মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিক ভাবে অনশন ভাঙার মুহূর্তে তিনি আবার ঘোষণা করলেন সে কথা। এ বার আরও স্পষ্ট করে জানালেন নিজের লক্ষ্য। ইরম চানু শর্মিলা এ দিন বলেছেন, ‘আমি রাজনীতিতে নামতে চাই। আমাকে মণিপুরের লৌহমানবী বলা হয়, আমি লৌহমানবী হয়েই বাঁচতে চাই। আমি মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী হতে চাই এবং আমি চাই মানুষ আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন।’ রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করেই মণিপুর থেকে আফস্পা তুলতে চান তিনি, জানিয়েছেন শর্মিলা।

গত মাসেই শর্মিলা ইম্ফলের আদালতে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি অনশন তুলে নেবেন। আদালতকে তিনি জানিয়েছিলেন, ৯ অগস্ট তিনি অনশন তুলতে চান। সেই অনুযায়ী মঙ্গলবার সকালেই শর্মিলাকে ইম্ফল জেলা আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। জামিনে তাকে মুক্তি দেয় আদালত। ফের শর্মিলাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বিচারবিভাগীয় হেফাজতে। প্রয়োজনীয় নথি আদালত থেকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছনোর পর, তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তার পর সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ভাবে মধু খেয়ে অনশন ভাঙেন শর্মিলা।

শর্মিলা জানিয়েছেন তিনি এ বার থেকে একটি আশ্রমে থাকবেন। শর্মিলার মুক্তি নিশ্চিত হতেই প্রাণনাশের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু শর্মিলা জানিয়েছেন, তিনি কোনো নিরাপত্তা রক্ষী নেবেন না। বিধানসভা নির্বাচনে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসেবে লড়বেন বলে শর্মিলা জানিয়েছেন। মণিপুরের আরও অন্তত ২০টি বিধানসভা কেন্দ্রে শর্মিলা প্রার্থী দিতে চাইছেন। নির্দল হিসেবে লড়ার জন্য অন্তত ২০ জনকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন ‘লৌহমানবী’। জনতা দল (ইউনাইটেড) ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে, মণিপুরের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে শর্মিলা ও তার অনুগামীদের তারা সমর্থন করবে। শর্মিলা অনশন ভাঙার আগেই জেডিইউ-এর তরফে থেকে মঙ্গলবার এ কথা ঘোষণা করা হয়। তার পাশে দাঁড়িয়ে ওকরাম ইবোবি সিংহের সরকারে পতন ঘটানোর জন্য মণিপুরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আত্মবিশ্বাসী শর্মিলা।

মানুষকে ভালবেসে, মানবাধিকারের দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন। একজন ব্যক্তি মানুষকে ভালবেসে এ বার সেই অনশন ভাঙতে চান তিনি। আর তাতেই তেলে-বেগুন তার সমর্থক-বন্ধু, এমন কী, নিজের মা-ও! ইরম শর্মিলা চানু। মণিপুরের এই ‘লৌহমানবী’ আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ভাঙবেন অনশন। গত ১৬ বছর ধরে ‘আফস্পা’ প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন চালিয়ে গিয়েছেন তিনি।  তাকে হাসপাতালে বন্দি করে নাক দিয়ে জোর করে রাইলস টিউব পুরে দিয়েছেন সরকারি ডাক্তার। খুলে ফেলেছেন শর্মিলা। ফের আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ভাবেই চলেছে পৃথিবীর ইতিহাসের দীর্ঘতম অনশন-পর্ব।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ভারতের যে সব রাজ্যে আফস্পা জারি রয়েছে (যেমন কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বের কয়েকটি রাজ্য), সেখানেও যা খুশি তাই করতে পারবে না সেনাবাহিনী। তারপরেই ২৭ জুলাই আদালতে দাঁড়িয়ে শর্মিলা আচমকা ঘোষণা করেন, ৯ অগস্ট অনশন ভাঙলেন তিনি। তার পর বিয়ে করে প্রেমিকের সাথে ঘরও বাঁধতে চেয়েছেন ৪৪ বছরের শর্মিলা।