ভেঙে দিয়েছে দাঁত : তুলে নিয়েছে হাতের নখ : পুলিশ সুপারের সুদৃষ্টি কামনা
জগন্নাথপুর থেকে ফিরে বখতিয়ার হোসেন বকুল: আদমব্যাপারীর খপ্পরে পড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর পর ইরাকে দালালের হাতে বন্দি দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের মৃত ভিকু শেখের ছেলে দিনমজুর যুবক মনিরুল ইসলাম মনিরের (৩৪) ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইরাকে অবস্থানরত বাংলাদেশের দালাল নোয়াখালীর জসিম মনিরের ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতনের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে পাঠিয়েছে মনিরের পরিবারের কাছে। মনিরের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করেছে ২১ লাখ টাকা। টাকা পরিশোধ না করলে বারবার মোবাইলফোনে দেয়া হচ্ছে হত্যার হুমকি। পাষণ্ড ওই দালাল জসিম ইতোমধ্যেই প্লাস দিয়ে তুলে নিয়েছে মনিরের দু হাতের ৭টি আঙুলের নখ। ভেঙে দিয়েছে মুখের ১০টি দাঁত। মনিরের ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখে ভেঙে পড়েছে তার পরিবারের লোকজন। তাকে মুক্ত করতে পরিবারের সদস্যরা সহায় সম্বল বেঁচে ইরাকের দালালের কাছে পাঠিয়েছে ৭ লাখ টাকা। ঘরে নেই কোনো খাবার। দু দিন অনাহারের পর প্রতিবেশীরা গ্রাম থেকে চাল তুলে ওই পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। মনিরের ওপর চালানো নির্যাতনের দৃশ্য দেখে তার পরিবারের সদস্যরা যখন দিশেহারা, প্রতিবেশীরা যখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ঠিক সে সময়ে ওই পরিবারের লোকজনের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছে জগন্নাথপুরের এক প্রভাবশালী নেতা। ঢাকার এক ওসির মাধ্যমে মনিরকে মুক্ত করে আনার নাম করে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় লক্ষাধিক টাকা। গ্রামের অধিকাংশ লোকজনের ধারণা ওই প্রভাবশালী নেতা পেছন থেকে নাড়ছেন কলকাঠি। তাকে গ্রেফতারের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। এলাকার একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেছেন, ওই প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেফতার করলেই নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পাবে মনির। এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন এলাকাবাসীসহ ভুক্তভোগী মনিরের পরিবারের লোকজন।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের মৃত ভিকু শেখের ছেলে দিনমজুর মনিরুল ইসলাম মনিরকে মোট অঙ্কের মাইনের প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় ওই গ্রামের আদমব্যাপারী তেতুল মণ্ডলের ছেলে সবুর (৪০)। মাস দুয়েক আগে মনিরকে নিয়ে ইরাকে পাড়ি জমায় আদমব্যাপারী সবুর। ওখানে পৌঁছানোর পর আদমব্যাপারী সবুর মনিরকে তুলে দেয় ইরাকে অবস্থানরত দালাল নোয়াখালীর জসিমের হাতে। মনিরকে জিম্মায় রেখে কৌশলে বাড়ি ফিরে আসে সবুর। এরপর ইরাকের দালাল জসিম মনিরকে বলে, সবুরের কাছে ভিসা বাবদ ২১ লাখ টাকা পাবো। তোকে জিম্মা রেখে গেছে। ওই টাকা তুই ব্যবস্থা করে দিবি। না হলে তোকে মেরে ফেলবো। দালাল জসিম মনিরের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। প্রথমে তার মুখের বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে দেয় ওই পাষণ্ড দালাল জসিম। চাবুক দিয়ে পিটিয়ে তুলে নেয়া হয় গায়ের চামড়া। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মনির বিষয়টি তার ভাইদের কাছে জানায়। বলে ২১ লাখ টাকা না দিলে আমাকে মেরে ফেলবে। এ কথা শুনার পর মনিরের ভাই বুলবুলসহ তার পরিবারের লোকজন ছুঠে যায় আদমব্যাপারী প্রতিবেশী সবুরের বাড়িতে। সবুর বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এলাকা ত্যাগ করে। বর্তমানে সবুরের পিতা তেতুল মণ্ডলও বাড়িঘরে তালা লাগিয়ে সপরিবারে সটকে পড়েছেন। উপায়ান্তর না পেয়ে মনিরকে জীবিত ফিরে পেতে তার পরিবারের লোকজন সহায় সম্বল বিক্রি করে ৭ লাখ টাকা পাঠায় ওই দালাল জসিমের কাছে। এরপর দালাল জসিম মুক্তিপণ হিসেবে মনিরের পরিবারের কাছে আরও ১১ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না পেয়ে বাড়িয়ে দেয় নির্যাতনের মাত্রা। পাষণ্ড দালাল জসিম প্লাস দিয়ে উপড়ে নেয় মনিরের দু হাতের ৭টি আঙুলের নখ। মনিরের ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতনের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে পাঠানো হয় তার পরিবারের কাছে। কয়েক দফায় মোবাইলফোনে হত্যার হুমকি দেয় ওই দালাল জসিম। ভাইকে জীবিত ফিরে পেতে মনিরের ভাই বুলবুলসহ তার পরিবারের লোকজন যখন দিশেহারা ঠিক ওই সময়ে তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয় গ্রামেরই এক প্রভাবশালী নেতা ইয়াছনবী। সে মনিরের পরিবারের লোকজনকে বলে, ঢাকায় আমার এক পরিচিত ওসি আছে। আমি ওই ওসিকে দিয়ে নোয়াখালী থেকে জসিমের বাপকে ধরে এনে মনিরের মুক্তির ব্যবস্থা করবো। দিশেহারা মনিরের পরিবারের লোকজন তার কথায় রাজি হয়। ধারদেনা করে প্রায় লক্ষাধিক টাকা তুলে দেয় ওই নেতার হাতে। ইয়াছনবী গত ১১ জুলাই জগন্নাথপুরের মোস্তফা, ইন্নাল শেখ, আনোয়ার এবং মনিরের ভাই ইমরোজকে সাথে নিয়ে মাইক্রোযোগে ঢাকায় যান। মীরপুরের প্রিন্স নামক এক বিলাস বহুল হোটেলে রাত্রিযাপন শেষে পরদিন বাড়ি ফেরে তারা। এ বিষয়ে মনিরের ভাই ইমরোজ জানান, আমি ইয়াছনবীর হাতে ৭৪ হাজার টাকা তুলে দিই। এছাড়া মাইক্রোভাড়া বাবাদ ১৮ হাজার টাকা, হোটেল ভাড়াবাবদ ৬ হাজার টাকা, খাওয়া খরচ বাবদ ৩ হাজার টাকা সর্বমোট ১ লাখ ১ হাজার টাকা ওই দু দিনে খরচ হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমরা বুঝতেই পারিনি যে ইয়াছনবী আমাদের সাথে এরকম প্রতারণা করবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশকিছু গ্রামবাসী জানায়, ওই ইয়াছনবীই হচ্ছে নাটের গুরু। সেই পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। তাকে গ্রেফতার করলেই মনির মুক্ত হয়ে দেশে ফিরতে পারবে। তারা আরও বলেন, সে ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী নেতা। ভয়ে এলাকার কেউই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
এলাকাবাসী চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপারের সৃদৃষ্টি কামনা করে বলে, স্যার আপনি কিছু করুন আর নাই করুন অন্তত একবার জগন্নাথপুরের এসে দেখে যান ওই অসহায় পরিবারের করুণ অবস্থা আর আহাজারির চিত্র। আমরা জানি পুলিশ সুপার একজন ন্যায় পরায়ণ ব্যক্তি। আমরা আশা করছি গ্রামবাসীর আকুতি উনি নিশ্চয় শুনবেন। আমরা ওনার পথ চেয়ে থাকলাম।
এ বিষয়ে দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি আবু জিহাদ বলেন, মনিরের ভাই বুলবুল বাদী হয়ে আদমব্যাপারী সবুরসহ মোট ৫ জনকে আসামি করে আমলি আদালতে মামলা করেছেন। ওই মামলাটি গতকাল বৃহস্পতিবার নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে। ইয়াছনবীর বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু ওই মামলায় ইয়াছনবীকে আসামি করা হয়নি সে কারণে তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। তবে তার বিরুদ্ধে এলাকার লোকজন মৌখিকভাবে আমার কাছে বেশকিছু অভিযোগের কথা জানিয়েছে। আমরা সেগুলো খতিয়ে দেখছি। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে।