স্টাফ রিপোর্টার: সংসদ সদস্যদের চোর বলার পর অব্যাহত সমালোচনার মুখে সংসদ অধিবেশনে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। গতকাল সোমবার দুপুরে মন্ত্রিসভায় সমালোচনার পর সন্ধ্যায় সংসদ অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন জাসদ সভাপতি ইনু। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিজের বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলে সংসদ সদস্যরা তাতে সম্মত না হয়ে ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলেন। তখন তথ্যমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যমে আমার বরাত দিয়ে যে বক্তব্য এসেছে, সেজন্য আমি ক্ষমা চাইছি, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশন পরিচালনা করছিলেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
গত রোববার পিকেএসএফ’র অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় ইনু প্রকল্পে টিআর, কাবিখা প্রকল্পে দুর্নীতির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমি তো এমপি আমি জানি, টিআর কীভাবে চুরি হয়। সরকার ৩০০ টন দেয়, এরমধ্যে এমপি সাহেব আগে দেড়শ টন চুরি করে নেন। তারপর অন্যরা ভাগ করেন। সব এমপি করেন না। তবে এমপিরা করেন। এই বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে রাতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মন্ত্রী ঢালাওভাবে সংসদ সদস্যদের দায়ী করেননি এবং ওই বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তবে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি উঠলে ইনু ওই বক্তব্যের জন্য আরেক দফা দুঃখ প্রকাশ করেন বলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী জানান। একজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ নিয়ে আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ওই বক্তব্য দিয়ে তিনি (তথ্যমন্ত্রী) নিজেই নিজেকে চোর বানিয়েছেন। এরপর সন্ধ্যায় সংসদ অধিবেশনে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের জোট শরিক জাসদের সভাপতি ও মন্ত্রী ইনুর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা তোলেন।
অনির্ধারিত আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আজকে পত্রিকায় দেখলাম তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, টিআর-কাবিখার অর্ধেক বরাদ্দ এমপিদের পকেটে। এ সময় সংসদ সদস্যরা শেইম, শেইম বলে ওঠেন। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, মাননীয় স্পিকার আপনি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, আমরা ৩৫০ জন সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্য নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তথ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের জন্য সকল সংসদ সদস্যদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। আপনার রুলিং দাবি করছি। একই সাথে তথ্যমন্ত্রীর এলাকায় টিআর কাবিখার কী কী কাজ হয়েছে, তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এরপর জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমরা যারা ৩৫০ সংসদ সদস্য আছি মনে হচ্ছে সবাই চোর হয়ে গেছি। আর একজন সাধু আছেন-তথ্যমন্ত্রী। উনি বলে দিছেন কাবিখার ১৫০ টন এমপিদের পকেটে যায়। অর্থাৎ কোনো কাজই হয় না। গ্রামগঞ্জে যে এত উন্নয়ন হচ্ছে তা কি বাতাসে হয়? উনি নিজেও তো উন্নয়নের কথা বলেন। একটা বিশেষ সময় অতিক্রম করছি, এই সময় জাতিকে কী মেসেজ দিচ্ছেন। এটা ক্ষমার অযোগ্য। স্পিকারকে উদ্দেশে তিনি বলেন, এই সংসদে সবাই মর্মাহত। উনি (ইনু) নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবেন, এর বিকল্প নেই। যেভাবে অপমান করেছেন, এই সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইবেন।
স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকলে রেসপনসিবিলিটি নিয়ে কথা বলতে হবে। উনি কোন তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা বললেন? একজন-দুজনের বিষয়ে তথ্য থাকলে বলতে পারতেন। উনি সবাইকে বললেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবাইকে বললেন! আমার এলাকায় এক টাকার অনিয়ম দেখাতে পারলে পদত্যাগ করবো। উনার এলাকায়ও তদন্ত হওয়া দরকার।
ফরাজী বলেন, আমরা তার বক্তব্যে ধিক্কার জানাই। উনি অধিদপ্তর থেকে বিবৃতি দিলেন। প্রথমে একবার অপমান করলেন। পরে আবার চিঠি দিয়ে অপমান করলেন। সংসদকে হেয় করার রাইট তার নেই। তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। সংসদ অবমাননা করেছেন। এরপর স্পিকার তথ্যমন্ত্রী ইনুকে ফ্লোর দিলে সংসদ সদস্যরা হই চই করে ওঠেন। ইনু বলেন, টিআর-কাবিখা এবং মাননীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গণমাধ্যমে আমার যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। মাননীয় সদস্যবৃন্দ এবং জনপ্রতিনিধিবৃন্দ যে কষ্ট পেয়েছেন, সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে অতীতের সরকারের অব্যবস্থাপনা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টার বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে ক্ষেত্র বিশেষের উদাহরণ হিসেবে দুর্নীতির কথা বলেছিলেন বলে দাবি করেন তিনি। তখন সংসদ সদস্যরা আবার হই চই করে ওঠেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যমে কিছু এসেছে, কিছু আসেনি। মাননীয় স্পিকার গণমাধ্যমে আংশিক এসেছে। আমি নিজে সংসদ সদস্য হিসেবে জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকভাবে সম্মান করি এবং সেটা অক্ষুণ্ণ আছে। আজকে আমি আপনার মাধ্যমে সংসদ সদস্য-জনপ্রতিনিধিদের কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। এ সময় সংসদ সদস্যদের অনেকে মাইক ছাড়াই বলতে থাকেন- ক্ষমা চাইতে হবে। এর মধ্যেই ইনু বলেন, সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে যে বক্তব্য এসেছে, তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। জঙ্গি দমনের যোদ্ধা হিসেবে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ গ্রহণ করবেন এবং বাধিত করবেন। সাথে সাথে কাজী ফিরোজ রশীদ ও আবু হোসেন বাবলা নিজ আসেন দাঁড়িয়ে মাইক ছাড়া কথা বলতে শুরু করেন। বাবলা বলেন, উনাকে ক্ষমা চাইতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এ সময় সরকারি দলের অনেকেই দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাত তুলে সবাইকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে স্পিকার শিরীন শারমিন বলেন, এখানে আলোচনা শেষ। এরপরেও যদি কোনো বক্তব্য থাকে, তবে আমার সাথে আলাপ করবেন। আপনারা কী চাচ্ছেন, সেটা বুঝতে হবে। সংসদ সদস্যরা হই চই অব্যাহত রাখলে ইনুকে আবার ফ্লোর দেন স্পিকার। তখন তিনি দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।