মুজিবনগরের ঐতিহাসিক আম্রকানন রামনগরের জমিদার বাবুর!

 

৭১র ১৭ এপ্রিল যেখানে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণ হয়

মহাসিন আলী: মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালী ইউনিয়নের রামনগরের জমিদারদের রেখে যাওয়া বৈদ্যনাথতলার আমবাগানকে ঘিরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ওই আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম (অস্থায়ী) সরকার গঠন করা হয় এবং এখানেই ওই সরকার শপথ গ্রহণ করেন। বৈদ্যনাথ তলার নাম করণ করা হয় মুজিবনগর। ওই মুজিবনগরই বাংলাদেশের প্রথম (অস্থায়ী) রাজধানী।

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার রামনগর জমিদার বাড়ি। জমিদার পরিবার ভারতে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এলাকার ২শ থেকে আড়াইশ বছরের জমিদারি শাসনের অবসান হলেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি জমিদার বাড়িটি। ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের সময় সম্ভ্রান্ত একটি মুসলিম পরিবারের সাথে সম্পত্তির বিনিময় করে জমিদার পরিবার ভারতে চলে যান। মুসলিম পরিবারের সযত্নে বসবাসের কারণে জমিদারদের চুন-শুরকি আর কড়ি-বর্গার ভবনগুলো আজও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে বাবুদের বাড়ির সিংহ তোরণে সিংহ নেই সেখানে করা হয়েছে শান্তির পতাকা চাঁদ-তাঁরা।

মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের সত্তর ঊর্ধ্ব নজরুল গাজী জানান, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে ছিলেন জমিদার সুবাস বাবু। জমিদার সুবাস বাবুর সেরেস্তা ছিলেন রামবাবু। রামবাবু জমিদার সুবাস বাবুর জমিদারির একটি অংশ দেখাশোনা করতেন। কৌশলে তিনি ওই অংশটি তার দখলে নেন। পরবর্তীতে রামবাবু বসতবাড়ি গড়ে তোলেন ভৈরব নদের পশ্চিমপাড়ে এবং জমিদারি শুরু করেন। তিনি যে স্থানে বসতবাড়ি গড়ে তোলেন ওই স্থানের নামকরণ করা হয় রামনগর। রামবাবু শুধু কৌশলে সুবাস বাবুর জমিদারির একাংশ নিজের দখলে নেননি। তিনি সুবাস বাবু জমিদারী কুক্ষিগত করার চেষ্টা করতে থাকেন। পরবর্তীতে সুবাস বাবু নব্য জমিদার রামবাবুকে দমন করতে তার লোক লস্কর ও লাঠিয়াল বাহিনী পাঠান। তুমুল যুদ্ধ হয় বিরোধপূর্ণ দুই জমিদার পরিবারের মধ্যে। যুদ্ধে সুবাস বাবু পরাজয় বরণ করেন। জমিদার রামবাবু তার জমিদারি পরগনা বাড়াতে থাকেন। আর আস্তে আস্তে সুবাস বাবুর জমিদারিতে ভাটা নামতে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি তার জমিদারি রামবাবুর হাতে তুলে দিয়ে ভারতে চলে যান।

রামনগরের জমিদার রামবাবুর জমিদারী ছিলো ভারতের হৃদয়পুর, তেহট্ট, পাথরঘাটা, কালীগঞ্জ, কৃষনগর, বাংলাদেশের বর্তমান মুজিবনগর উপজেলার রামনগর, বল্লভপুর, মানিকনগর, বাগোয়ান, ভবরপাড়া, সোনাপুর, নাজিরাকোনাসহ আশেপাশের ২৫ থেকে ৩০টি গ্রামজুড়ে।

সরেজমিনে রামনগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জমিদাররা নেই। ভৈরব নদের পশ্চিম তীরে রয়েছে তাদের স্থাপনা বসতবাড়ি। বিশাল পাঁচিল ঘেরা মূল বাড়িতে ঘোড়াশালা, পোস্ট আফিস, বিশাল ব্যাস ও গভীরতার একটি পাতকূয়া। পাতকূয়াটির পানি এখন আর কেউ খায় না। তাই পাতকূয়ার ওপরে মজবুত ঢালাইয়ে স্লাব দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশাল পাঁচিল ঘেরা সীমানায় দ্বিতল ভবনের মোট ২৪টি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া অন্য বাড়িগুলোও দ্বিতল ভবনে ২০ থেকে ২৪টি করে করে কক্ষ আছে। বারান্দার সৌন্দর্যখচিত কমপক্ষে ৬টি করে পিলার এবং চুন-শুরকি আর কড়ি-বর্গার ভবনের ৩০ ইঞ্চি দেয়ালগুলো আজও শোভাবর্ধন করছে। তবে সৌন্দর্যখচিত নকশাগুলোর অনেকটা খসেখসে পড়েছে। পাঁচিলের ভেতরে রয়েছে জমিদার বাড়ির রমণীদের গোসল করার জন্য শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। এছাড়া বাড়ির পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদে জমিদার পরিবারের পুরুষদের গোসলের জন্য তৈরি করা সিঁড়ি পুরাতন হয়েও স্মৃতি বহন করছে। বাড়ির পেছনে রয়েছে প্রায় দেড়শ বিঘা জমির ওপর আমবাগান। সবই রয়েছে নেই শুধু জমিদার পরিবার। জমিদার রামবাবু ও তার ছেলে কেদার বাবু যে বাড়িটিতে বাস করতেন সেই বাড়িটি দূর থেকে দেখে বিশ্বাস করা যায় না যে বাড়িটি আড়াইশ বছরের পুরোনো বাড়ি। তবে বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে এটি অনেক পুরোনো দিনের ইতিহাস এবং কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

স্থানীয় রামনগর গ্রামের অতশীপর বৃদ্ধ সিরাজউদ্দিন জানান, জমিদার রামবাবুর একমাত্র ছেলে ছিলেন কেদারনাথ বায় বাবু। জমিদার পুত্র কেদারনাথ রায় বাবুর নাম অনুসারে কেদারগঞ্জ। বর্তমান নবসৃষ্ট মুজিবনগর উপজেলার একমাত্র বড়বাজার কেদারগঞ্জ। জমিদার রামনাথ বাবুর মৃত্যুর পরে তার জমিদারি চলে যায় একমাত্র ছেলে কেদারনাথ রায় বাবুর হাতে। মুজিবনগরের ঐতিহাসিক আম্রকানন জমিদার কেদারনাথ রায় বাবুর তৈরি। বর্তমানে সরকারি ওই আম্রকাননে প্রায় সাড়ে এগারশটি আমগাছ রয়েছে। বিশাল ওই আম বাগানে বসেই বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম (অস্থায়ী) সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনটি স্মরণ করতে প্রতি বছরের ১৭ এপ্রিল ওই আমবাগানে মুজিবনগর দিবস পালন করা হয়। জমিদার কেদারনাথ বাবুর ওই আম বাগানটি ভারত সীমান্তবর্তী সর্ববৃহৎ ও নিরাপদ আম্রকানন। যেখানে বন্ধু প্রতীম ভারতের সহযোগিতায় দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুনসুর আহমেদ প্রমুখ জাতীয় নেতাদের উপস্থিতিতে নবসৃষ্ট বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। স্থানীয় ১২ জন আনসার সদস্য তাদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। কেদারনাথ রায় বাবুর আম্রকাননে স্মৃতিসৌধ, শেখ হাসিনা মঞ্চ, রেস্ট হাউজ ইত্যাদি গড়ে ওঠেছে। এখানেই শেষ নয়। ওই আমবাগানকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রথম (অস্থায়ী) রাজধানী মুজিবনগর। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার মুজিবনগর উপজেলা গঠন করে এবং মুজিবনগরের ঐতিহাসিক আম্রকানন ঘিরে গড়ে উঠেছে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। যেখানে সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছে। বর্তমানে মুজিবনগর একটি পর্যটন কেন্দ্র।

জমিদার কেদারনাথ রায় বাবুর ছিলো ৩ ছেলে। তাদের নাম সতীশ চন্দ্র রায়, ক্ষিতিশ চন্দ্র রায়, শিব চন্দ্র রায়। জমিদার কেদারনাথ রায় বাবু তিন ছেলের বসবাসের জন্য আরো দুটি বসতবাড়ি করেন। পরবর্তীতে জমিদারের ৩ ছেলে জমিদারি দেখাশোনা করতে থাকেন। বড় ছেলে জমিদার সতিশ বাবুর গোমস্তা ছিলেন তারই প্রজা হেলাল উদ্দিন মোল্লা। ওই সময় জমিদার বাড়ির পোস্ট মাস্টার ছিলেন আলহাজ সামছুল ইসলাম।

দীর্ঘ ২শ থেকে আড়াইশ বছর জমিদারির পর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় জমিদাররা ভারতে চলে যান। যাওয়ার সময় চেক পদ্ধতিতে জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়ে যান। বর্তমানে সতীশ চন্দ্রের বাড়িতে বাস করেন আলহাজ সামছুল ইসলাম মোল্লার ৩ ছেলে মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মোল্লা, মোনাখালী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মোল্লা ও কৌশিকুল ইসলাম মোল্লা। শিবচন্দ্র রায়ের বাড়িতে বাস করেন মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে সিরাজ উদ্দিন, জসিম উদ্দিন ও নাসির উদ্দিন এবং ক্ষিতিশ চন্দ্র রায়ের বাড়িতে বাস করছেন মৃত সামছুদ্দিনের ছেলে আব্দুল হান্নান, নজরুল ইসলাম, মোজাম্মেল হক, আনিসুল ইসলাম, ইমদাদুল হক ও আবু বক্কর সিদ্দিক।

এদিকে মুজিবনগর উপজেলার ভবানীপুরে সুবাস বাবুর ছেড়ে যাওয়া বাড়ি গিয়ে দেখা যায় সে বাড়িতে বর্তমানে বাস করছেন ডা. কোমর উদ্দিনের ৩ ছেলে রকিবুল ইসলাম কাঁচা, রফিকুল ইসলাম ও রবিউল ইসলাম কচি।

 

Leave a comment