নিখোঁজ তালিকা বিতর্কিত ভাবমূর্তি সঙ্কটে অনেকে

স্টাফ রিপোর্টার: নিখোঁজ ২৬২ জনের তালিকা নিয়ে উঠেছে নানা বিতর্ক। দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এ তালিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে; তেমনি যারা উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত নয়; তাদের নাম তালিকায় আসায় সমাজে তারা ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়েছেন। এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকেও এমন অভিযোগ তোলা হচ্ছে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় বড় ধরনের জঙ্গি হামলার পর জঙ্গি সন্ত্রাস নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। আরও হামলার আশঙ্কায় দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি নিখোঁজ লোকজনের বিষয়ে জোর অনুসন্ধান শুরু হয়। বিশেষ করে যেসব তরুণ নিখোঁজ রয়েছে, অথচ তার পরিবারের পক্ষ থেকেও সন্তোষজনক জবাব মিলছে না সে ধরনের ব্যক্তিদের সন্দেহের প্রথম সারিতে আনা হয়। এছাড়া গোয়েন্দা তথ্যসহ সন্দেহের নানা উপাদান মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ১৯ জুলাই ২৬২ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বভাবত এ তালিকার খবরটি দেশী ও বিদেশী গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। ধরেই নেয়া হয় এদের অনেকে জঙ্গি খাতায় নাম লিখে নিরুদ্দেশ হয়েছে। এদিকে তালিকা প্রকাশের পরদিন থেকে ভিন্নচিত্র ফুটে ওঠে। দেখা যাচ্ছে, তালিকায় যাদের নাম-পরিচয় এসেছে তাদের কিছুসংখ্যক বাড়িতেই আছেন। কেউ কেউ বাড়ি ছেড়েছেন প্রেমের টানে। এমনকি মৃত ব্যক্তিকেও নিখোঁজ দেখিয়ে তালিকাভুক্ত করা হয়। এতে করে গত কয়েকদিন তালিকাটি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। গুরুত্বপূর্ণ তালিকাটি বিতর্ক ও অনাস্থার খোরাকে পরিণত হয়।
উদাহরণস্বরূপ এ তালিকায় আছে ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মুন্সীরহাট গ্রামের নূরুজ্জামান আরিফের নাম। অথচ তিনি বর্তমানে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। নিখোঁজের তালিকায় তার নাম দেখে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তার বাবা আবু তালেব। তিনি জানান, ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে ৱ্যাব তার ছেলেকে গ্রেফতার করে। ৱ্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে তাকে জেএমবির সদস্য বলে দাবি করা হয়। পরে তাকে সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে থানায় সোপর্দ করা হয়। তার বিরুদ্ধে ৱ্যাব বাদী হয়ে দুটি মামলাও দেয়। ওই মামলায় নূরুজ্জামান আরিফকে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে আরিফ গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন। এখন সেই ৱ্যাবই তার নাম নিখোঁজের তালিকায় দেখাচ্ছে। আবু তালেব বলেন, ‘এসব ঘটনায় আমরা নতুন করে ভয়ের মধ্যে আছি।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, তালিকায় নিখোঁজ ২৬২ জনের মধ্যে অনেকেই ফিরে এসেছেন। তাদের সংখ্যা প্রায় ১০০। এ তালিকার অনেকেই আছেন বাড়িতে। কেউ কেউ আছেন কারাগারে। কেউ স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে ঘর ছাড়লে তাকেও স্থান দেয়া হয়েছে এ তালিকায়। পুলিশের আইজিপিও প্রশ্ন তুলেছেন এ তালিকা নিয়ে। পুলিশ প্রধান একেএম শহীদুল হক বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ তালিকা অপূর্ণাঙ্গ। তালিকার সবাই জঙ্গি নন। এরকম তালিকা পুলিশের কাছেও আছে। পুলিশের পক্ষ থেকে যাচাই-বাছাই শেষে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তদের একটি নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে।’ তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ৱ্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান শুক্রবার বলেন, ‘তালিকাটি প্রাথমিকভাবে তৈরি করা। দেশের বিভিন্ন থানায় জিডির পর নিখোঁজদের তালিকা এটি। তালিকাটি যাচাই-বাছাই করে সংশোধিত একটি তালিকা তৈরি করা হবে। এনিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কিছু নেই।’ এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, ‘একটি এলিট ফোর্সের পক্ষ থেকে যখন কোনো তালিকা দেয়া হয় তখন আমরা ধরেই নেই তারা যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে এ তালিকা তৈরি করেছে। ওই এলিট ফোর্সের পক্ষ থেকে ২৬২ জনের তালিকা দেয়া হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তালিকাটিতে নানা ধরনের ত্রুটি বিদ্যমান। দেখা যাচ্ছে, তালিকাভুক্ত অনেকেই বাসা- বাড়িতেই আছেন। তালিকা প্রকাশের আগে প্রত্যেকটি তথ্য আরও পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করে নিলে ভালো হতো।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা উগ্রবাদী বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত নন এ রকম নাম তালিকায় আসার কারণে পরিবার ও সমাজের মধ্যে তারা এক ধরনের সামজিক সঙ্কটে পড়েছেন। সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। অনেকে তাদের এখন সন্দেহের চোখে দেখছেন।’ তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে- ‘ঝিনাইদহ জেলার ২৯ জনের নাম আছে। তাদের মধ্যে দু’জন প্রতিবন্ধী। তারাসহ ২৪ জন বাড়িতেই আছেন। তাদের কেউই উগ্রবাদী বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত নন। তালিকার দু’জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তারা হলেন ঝিনাইদহ পৌরসভার খাজুরা গ্রামের কমিশনার গোলাম মোস্তফার বড় স্ত্রীর ছেলে দেলোয়ার হোসেন দুলাল ও একই গ্রামের গোলাম আজম। ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাদের হত্যা করে লাশ ফেলে যায়। অথচ নিখোঁজের তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। তালিকার ৬২ নম্বরে রয়েছেন রেজাউল করিম সোহেলের নাম। তিনি নিজ বাড়িতেই একটি ঘরে বন্দি বলে দাবি করেন তার বাবা। কারণ সোহেল মানসিক প্রতিবন্ধী। তালিকার ৬৩ নম্বরে থাকা মামুন রায়হান বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কালীগঞ্জ উপজেলার হেলাই গ্রামের মাজেদুল হক, দাদপুর গ্রামের আবু সাঈদ ও বলরামপুর গ্রামের মো. হাসান আলী নিজ বাড়িতে আছেন তারা। ২০৬ নম্বরে থাকা মহেশপুরের গোয়ালহুদা গ্রামের বাপ্পি ও ২৩২ নম্বরে থাকা একই গ্রামের ওয়াফিল বাড়িতেই আছেন। হরিণাকুণ্ডের কাচারিতোলা গ্রামের সবদুল হোসেন জানান তালিকায় নাম থাকা তার মেয়ের জামাই মো. মতিয়ার রহমান (৩০) মেয়ের সাথে ঝগড়া করে নিজ গ্রাম সাগান্নায় চলে যান। বিপদের আশংকা করে ওই সময় সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জিডি করেন তিনি। ৮১ নম্বরে থাকা একই উপজেলার আদর্শ আন্দুলিয়া গ্রামের শফিকুল ইসলামও বাড়িতেই আছে। পুলিশ বলছে জেলায় প্রকৃত নিখোঁজের সংখ্যা তিনজন।

ঢাকার কলাবাগান থেকে মাহমুদুর রহমান (কাজল) ১৪ মার্চ নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পর ফিরে আসেন। তার বাবা থানায় নিজে গিয়ে সেই খবর দিয়ে আসেন। অথচ তালিকায় তার নামও এসেছে।

ঢাকার আশুলিয়ার হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি তো নিখোঁজ না। বাড়িতে একটু ঝামেলা হয়েছিল। ১০-১২ দিন বাড়িতে ছিলাম না। তাই বড় ভাই থানায় জিডি করেন। তারপর ফিরে আসি। অথচ তালিকায় আমার নামও এসেছে।’

চট্টগ্রামের নিখোঁজের তালিকায় থাকা জানে আলম জানান, তার বাড়ি ময়মনসিংহে। তিনি ঝগড়া করে ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছ থেকে প্রথম স্ত্রীর কাছে ময়মনসিংহে চলে যান। পরে আবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গার বাসায় ফিরেছেন। তালিকার তার নামও রয়েছে।

নিখোঁজ তালিকায় থাকা রংপুরের বৈরাগীপাড়ার রেজওয়ানুর রহমান এখন রংপুর প্রেস ক্লাব ভবনের নিচ তলায় একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করছেন। তালিকার আরেকজন শায়েস্তা খান এখন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তিনি বাড়িতে থেকে নিয়মিত ক্লাস করছেন।
নীলফামারীতে নিখোঁজ বরকতুল্লাহ ১৭ মে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। নরসিংদীর কমর উদ্দিন ও শাহাজ উদ্দিন আছেন বাড়িতেই। বরিশালের নিখোঁজ মো. জোবায়ের হোসেন ফারুক বর্তমানে মালয়েশিয়ায়। তিনি বাড়িতে নিয়মিত ফোন করেন এবং টাকাও পাঠান। হবিগঞ্জের নিখোঁজ মাধবপুরের সুন্দোল গ্রামের নাহিদুল ইসলাম ইমন ২৮ বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। ১৪ জুলাই বাড়ি ফেরেন। কিন্তু তিনিও এখন তালিকাভুক্ত নিখোঁজ।