গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনী শহরের বাসিন্দা সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের প্রবাসী মিলন হোসেন (৩৪) হত্যা মামলার তদন্ত এগিয়ে চলেছে। তদন্তের অংশ হিসেবে হত্যকাণ্ডের সময় মিলনের হাতে ব্যবহৃত সোনার সেই ব্রেসলেট উদ্ধার করেছে মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। নিহতের স্ত্রী রিমান্ডে দেয়া স্বীকারোক্তিতে গতকাল বুধবার কলেজ পাড়ার একটি বাড়ি থেকে ব্রেসলেটটি উদ্ধার করা হয়। স্ত্রী ও তার পরকীয়া প্রেমিক মোজাম্মেলসহ অন্য আসামিরা মিলনকে নিজ বাসায় ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে বলে পরিবার থেকে আগেই অভিযোগ করা হয়। ব্রেসলেট উদ্ধারের মধ্যদিয়ে এ সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়েছে পরিবারের সদস্যদের মাঝে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট-সিআইডি) মামলাটি তদন্ত করছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মেহেরপুর আদালত নিহত মিলনের স্ত্রী মানছুরা খাতুন, বোন মসনুয়ারা খাতুন, ভগ্নিপতি আব্দুর রশিদ (পুলিশ কনস্টেবল) ও স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক কাষ্টদহ গ্রামের আবু বক্করের ছেলে গাংনী হাসপাতাল বাজারের হার্ডওয়ার ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হককে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিজ্ঞ আদালত। গত ১৩ জুলাই থেকে আসামিদেরকে মেহেরপুর সিআইডি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড শেষে আদালতে সোপর্দ করলে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে তাদেরকে আবারো জেলা কারাগারে প্রেরণ করে পুলিশ। মিলনের লাশ উদ্ধারের পর স্ত্রীসহ ৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং কিছু দিন পরে আদালতে আত্মসর্ম্পণ করে মোজাম্মেল।
এদিকে সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। কিন্তু মামলার সুষ্টু তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের স্বার্থে তা গোপন রাখা হয়েছে বলে জানায় সিআইডি। তবে স্ত্রী মানছুরার স্বীকারোক্তিতে একটি ভ্যানেটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। ২৫ এপ্রিল সকালে লাশ উদ্ধারের পর মানছুরা বেগম একটি ভ্যানেটি ব্যাগ তার বোনের বাড়িতে রেখে আসেন। তার বোন ওই ব্যাগটি কলেজপাড়ার স্কুল শিক্ষক আবু বক্কর ছিদ্দিকের স্ত্রী নিলুফা নাছরিনের কাছে রাখার কিছু সময় পরই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কিন্তু ব্যাগের বিয়টি অজানা রয়ে যায়। মানছুরার স্বীকারোক্তিতে নিলুফার কাছ থেকে ব্যাগটি উদ্ধারের পর তার মধ্যে থেকে টাকা ও কিছু জিনিসপত্রের সাথে মিলনের ব্যবহৃত সেই সোনার ব্রেসলেট উদ্ধার করা হয়।
নিহতের পরিবার ও স্বজনদের ধারণা মিলনের নিজ বাসায় হত্যা করে ঝিনেরপুল এলাকায় লাশ ফেলা হয়। আসামিরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ভিন্নখাতে ঘোরাতে লাশ সেখানে ফেলে রাখে। ব্রেসলেট উদ্ধারের মধ্য দিয়ে সেই সন্দেহের ভিত্তি মজবুত হচ্ছে।
নিহতের পিতা ও পরিবারের অভিযোগ, পরকীয়া প্রেম ও মিলনের উপার্জিত টাকা তছরুপ নিয়ে স্ত্রীর সাথে কলহ চলছিলো। তাছাড়া মোজাম্মেলের সাথে গভীর প্রেম পরিণয়ে বাধা হওয়ায় মিলনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার হওয়া ওই চার আসামি। তাই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মিলনের বাসায় স্ত্রী ও তার বোন-ভগ্নিপতি এবং মোজ্জাম্মেলসহ তার লোকজন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে। কেননা খুন হওয়ার আগের দিন বিকেলে মিলনের হাতে ওই ব্রেসলেটটি দেখেছিলেন তার পরিবারের লোকজন। সব সময় মিলনের হাতেই থাকতো ওই ব্রেসলেট। প্রায় দেড় ভরি ওজনের সোনার ব্রেসলেটটি মিলনের হাত থেকে খুলে নিয়ে লাশ ঝিনের পুল এলাকায় ফেলা হয় বলে ধারণা করছেন নিহতের পরিবার।
এদিকে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, উদ্ধার হওয়া ব্রেসলেটটি আলামত হিসেবে জব্দ দেখানো হয়েছে। বিষয়টি আদালতকে জানানো হবে। তবে হত্যাকাণ্ডের মূল্য রহস্য সম্পর্কে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি। এছাড়াও রিমান্ড আসামিদের দেয়া স্বীকারোক্তি সম্পর্কেও গোপন রেখেছে সিআইডি। মামলার আরো তদন্তের পর প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ জোগাড় করেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) প্রদান করা কথা বলেন তিনি।
ব্যাগ রাখা ও নারী হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে তাকে গ্রেফতার করা না হলেও তিনি সন্দেহের তালিকায় থাকছেন। তার ওপর নজরদারি থাকবে। তদন্তে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেলে তাকেও গ্রেফতার করা হবে।
নিহতের পারিবারিকসূত্রে জানা গেছে, নিহত মিলন হোসেন সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের আব্দুল হামিদ মল্লিকের ছেলে। কুয়েত থেকে ছুটিতে বাড়ি ফিরে স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে গাংনী শহরের বন বিভাগ পাড়ায় নিজ বাড়িতে বসবাস করছিলেন। বিদেশে দীর্ঘদিনে উপার্জিত টাকা দিয়ে বন বিভাগের পাশে জমি ক্রয় করেন স্ত্রী। স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালবাসা-বিশ্বাসের কারণে জমির মালিকানা স্ত্রীর নামে দিতে আপত্তি করেননি মিলন। কিন্তু সেই বিশ্বাসের ওপর কলঙ্কের কালিমা লেপে দিয়ে স্বামীর উপার্জিত টাকা পরকীয়া প্রেমের মধ্যদিয়ে তছরুপ করে মানছুরা খাতুন। বোন-ভগ্নিপতি ও পরকীয়া প্রেমিক মোজাম্মেলকে নিয়েই ছিলো তার সব কাজকর্ম। বিষয়টি টের পেয়ে মিলন আর দেশে ফিরতে চাইছিলেন না। এতো কষ্টে উপার্জিত টাকা দিয়ে তৈরি বাড়িতে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর এই অসামাজিক কর্মকাণ্ড কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন মিলন। কুয়েতে থাকা অবস্থায় এসব বিষয় নিয়ে স্বজনদের সাথেও কথা বলতেন তিনি। তবে মৃত্যু দূত ঠিকই তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। দেশে ফিরে শ্যামপুর গ্রামের বাড়িতে থাকেননি। স্ত্রী ও সন্তানের সাথে গাংনী বন বিভাগ পাড়ার সেই বাসায় যাত্রিযাপন করছিলেন। গত ২৫ এপ্রিল সকালে গাংনী শহরে উপকণ্ঠ ঝিনেরপুল পাড়া থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। আগের দিন রাতে তাকে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয় বলে ধারণা পুলিশের। মাথায় হাতুড়ি দিয়ে উপর্যুপরি মেরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই স্ত্রী, স্ত্রীর বোন-ভগ্নিপতি গ্রেফতার ও পরকীয়া প্রেমিক মোজাম্মেল আদালতে আত্মসমর্পণ করলেও এখনো তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোনো স্বীকারোক্তি মেলেনি। তাই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন নিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নিহতের পরিবার সুবিচার নিয়েও শঙ্কিত।
নিহতের মামা আব্দুল হালিম জানান, যে চলে গেছে তাকে তো আর ফিরে পাবো না। মিলনের মতো একজন ভালো ছেলের এভাবে চলে যাওয়া কিছুতেই ভোলা যায় না, ভোলা সম্ভব নয়। তাই এই জঘন্যতম হত্যকারীদের প্রত্যেকের ফাঁসি দেখতে চান তারা। যারা নির্মমভাবে মিলনকে হত্যা করেছে তাদেরকে যতক্ষণ না ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে ততক্ষণ শান্তি পাচ্ছেন না মিলনের পিতা-মাতা ও স্বজনরা। তবে মামলা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন ও হত্যাকারীদের যাতে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয় তাই মামলাটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান সিআইডি ইন্সপেক্টর হাসান ইমাম।