ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের সোনালীপাড়ায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলার পর এ জেলার আলোচিত চার সংখ্যালঘু হত্যা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরাসহ একজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, এসব হত্যায় তারা এখন এই জঙ্গিগোষ্ঠীকেও সন্দেহ করছেন। বছর খানেক ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুদের হত্যা করা শুরু হয়, যার অনেকক’টিতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নামে দায় স্বীকারের খবর বের হয়। একই কায়দায় ঝিনাইদহে গত ৬ মাসে ৪টি হত্যাকাণ্ড হয়। এই ৪টি হত্যায়ও একইভাবে আইএস দায় স্বীকার করে।
ঝিনাইদহে প্রথম হত্যাটি হয় চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি। ওই দিন সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের হোমিও চিকিৎসক ছমির উদ্দীন মণ্ডলকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে। তবে খবরটি প্রথম দিন গণমাধ্যমে আসেনি, খুব একটা জানাজানিও হয়নি। পরদিন আইএস এ হত্যার দায় স্বীকার করে এবং তাতে বলে যে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করায় ছমির মণ্ডলকে তারা হত্যা করেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আইএসের দায় স্বীকারের খবর বের হওয়ার পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিষয়টি জানতে পারে। পুলিশ আইএসের দাবিকে নাকচ করে দিলেও এখন পর্যন্ত এ মামলার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। এরপর গত ১৪ মার্চ রাতে কালীগঞ্জ উপজেলার নিমতলায় আরেক হোমিও চিকিৎসক ও শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী আবদুর রাজ্জাককে, ৭ জুন সদর উপজেলার করাতিপাড়া গ্রামের পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে এবং সর্বশেষ ১ জুলাই উত্তর কাষ্টসাগরা গ্রামের শ্রীশ্রী রাধা গোবিন্দ গোপাল বিগ্রহের (মঠ)
সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দেশের অন্যান্য এলাকার হত্যাকাণ্ডের মতো এসব হত্যায় শুরু থেকে জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও ঝিনাইদহ পুলিশ কিছু বের করতে পারেনি। কেবল পুরোহিত আনন্দ কুমার হত্যায় এনামুল হক নামে শিবিরের এক নেতা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। এর বাইরে এ ঘটনায় আর কেউ গ্রেফতার নেই।
মামলার বাদী ও পুরোহিতের ছেলে সিন্ধু কুমার গাঙ্গুলী বলেন, তদন্ত ও পুলিশের তৎপরতা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, ঢাকায় ও কিশোরগঞ্জে নিহত দুই জঙ্গিসহ আট জঙ্গি ঝিনাইদহ শহরে কওছার আলীর বাড়ি ভাড়া করে আস্তানা গেড়েছিল বলে এখন খবর বেরিয়েছে। ওই কওছার আলীর গ্রামের বাড়ি থেকে পুরোহিতের বাড়ির দূরত্ব আনুমানিক এক কিলোমিটার।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঝিনাইদহ সদর থানার উপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম বলেন, ঝিনাইদহে কোনো জঙ্গি আস্তানা ছিলো, সে বিষয়ে তিনি এখনো নিশ্চিত নন। বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়েছেন, এ বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। এ কারণে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলবেন না। জঙ্গিরা যে বাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছিলো, সেটা সদর থানা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। আর পুরোহিত আনন্দ গোপাল খুন হন সেখান থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে। সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস খুন হয়েছেন ওই জঙ্গি আস্তানা থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে আর শিয়া মতাবলম্বী আবদুর রাজ্জাক খুন হন ১৫ কিলোমিটার দূরে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, প্রত্যেকটি হত্যায় ৩ ব্যক্তি জড়িত এবং তারা একটি মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছে। আর সোনালীপাড়ার জঙ্গি আস্তানায়ও একটি মোটরসাইকেল ছিলো বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আলাউদ্দিন বলেন, এই মামলায় এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেননি। তদন্তে আদৌ কোনো অগ্রগতি আছে কি-না সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। শিয়া মতাবলম্বী আবদুর রাজ্জাক হত্যার তদন্তেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। রাজ্জাকের ভাই সাবজাল হোসেন বলেন, পুলিশের তদন্তের যে হাল, তাতে তারা সন্তুষ্ট নন। যদিও তদন্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার এসআই নীরব হোসেন দাবি করেছেন, দু-এক দিনের মধ্যে ভালো খবর দিতে পারবেন।
সম্প্রতি জঙ্গিদের আস্তানার সন্ধান মেলার পর এই চারটি হত্যার বিষয় আবার আলোচনায় আসে। বাড়ির মালিকের স্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, সোনালীপাড়ার ওই আস্তানায় আট জঙ্গি উঠেছিল চার মাস আগে। তার আগে-পরে ঝিনাইদহের অন্য কোথাও এভাবে ঘর ভাড়া নিয়ে জঙ্গিরা অবস্থান করেছিল কি-না, সেটা নিয়ে লোকজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, এ নিয়ে কাজ চলছে। শহরে কোথায় কোথায় মেস আছে, সেখানে কারা থাকছে, সে তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, গুলশান হামলায় যে জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত, তারা ঝিনাইদহেও বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে তারা এখন ধারণা করছেন।