ঝিনাইদহে বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেতার ছেলে ও এক যুবলীগ কর্মীসহ ৯ জন নিখোঁজ

 

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহে নিখোঁজের তালিকা আবারো দীর্ঘ হচ্ছে। এ নিয়ে শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এখন পর্যন্ত ঝিনাইদহে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতার ছেলে ও এক যুবলীগ কর্মীসহ ৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

নিখোঁজ থাকাদের মধ্যে রয়েছেন- ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পাগলাকানাই ইউনিয়নের কোরাপাড়া বটতলা এলাকার হোসেন আলী মোল্লার ছেলে যুবলীগ কর্মী জাহিদ ওরফে কোবরা জাহিদ, ঝিনাইদহ জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি খয়বর রহমানের ছেলে হলিধানী বাজারের রাশেদ ওরফে রোজ, শৈলকুপা উপজেলার চরফুলহরি গ্রামের আমিরুল ইসলাম মণ্ডলের ছেলে শাহিন হোসেন পরশ, শহরের আদর্শপাড়া কচাতলার আবুল কালাম আজাদের ছেলে মাদরাসা ছাত্র আব্দুর রব, কালীগঞ্জ উপজেলার হরিগোবিন্দপুর গ্রামের আরিফ হোসেনের ছেলে মিলন হোসেন, আরাপপুর চানপাড়ার মাদরাসার শিক্ষক শাহ আলমের ছেলে আজমুল হুদা, শৈলকুপার মুচড়াপাড়া পুটিমারী গ্রামের লুৎফর হোসেনের ছেলে ইবির ছাত্র সাইফুল ইসলাম মামুন, ঝিনাইদহ শহরের উপশহরপাড়া পাবলিক হেলথ জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন ছোটকামারকুণ্ডু গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে সোহল রানা ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পাবর্তীপুর গ্রামের শহিদুল সর্দারের ছেলে মাংস ব্যাবসায়ী উজ্জ্বল সর্দার। এর মধ্যে মাংস ব্যবসায়ী উজ্জ্বল ব্যতীত ৮ জনকে শাদা পোশাকের লোকজন পুলিশ পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর স্বজনরা তাদের আর খুঁজে পাচ্ছে না এমন অভিযোগ করা হয়েছে। এ নিয়ে সারা জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

এদিকে জঙ্গি দমনে ঝিনাইদহে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ঝিনাইদহে এক সেবায়েত ও পুরোহিতসহ ভিন্নমতের চারজন নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর পুলিশ অভিযান শুরু করেছে। এতে সাফল্যও পাচ্ছে পুলিশ ও ৱ্যাব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে কিছু লোমহর্ষক হত্যা ও আলোচিত হামলার সাথে ঝিনাইদহের অপরাধীরা জড়িত বলে তাদের হাতে তথ্য রয়েছে। এরমধ্যে ২১’র গ্রেনেড হামলা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হত্যা ও চট্টগ্রামে শিক্ষকের ওপর হামলার সাথে ঝিনাইদহের অপরাধীরা জড়িত ছিলো। ওই পুলিশ কর্মকর্তার মতে ঝিনাইদহে ৪০ জন জঙ্গির সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। যারা একটি ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। উগ্র ও সাহসী দেখে এসব যুবকদের রিক্রুট করা হয়েছে। পুলিশ তাদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে। ইতোমধ্যে সেবায়েত ও পুরোহিত হত্যার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই হামলার সাথে ইসলামী ছাত্র শিবিরকে দায়ী করে কড়া বক্তব্য দিয়েছেন।

এদিকে ঝিনাইদহের বিভিন্ন উপজেলা থেকে নিখোঁজ হওয়া যুবকদের সম্পর্কে পুলিশের স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের পরিবার নিখোঁজ সন্তানের সন্ধান চেয়ে জিডি করেছেন।

ঝিনাইদহ সদরের কোরাপাড়া বটতলা এলাকার সৌরভি খাতুন জানান, তার স্বামী জাহিদকে জুন মাসের ১ তারিখে পুলিশ পরিচয় দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো তিনি ফিরে আসেননি। নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির মেম্বারসহ অনেকেই বাধা দিয়েছিলেন বলেও তিনি জানান।

নিখোঁজ জাহিদের ভাই নাজিম মেম্বার জানান, তার ভাই যুবলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ঝিনাইদহের একটি ব্যাংক থেকে গুলি করে ১০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের পর কোবরা জাহিদ নিখোঁজ হন।

ঝিনাইদহ বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি ও সাবেক জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা খয়বার রহমান জানান, তার ছেলে রোজকে হলিধানী বাজার থেকে গত ২ জুলাই তুলে নিয়ে যায়। এরপর ৱ্যাব তার ঢাকায় বাসা থেকে রোজের ছবি ও মোবাইল নম্বর নিয়ে গেছে। এ নিয়ে গত ৩ জুলাই ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি জিডি করা হয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন।

আমার ছেলে রোজ যদি জঙ্গিদের সাথে সম্পর্ক করে তবে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচার হোক। রোজ কানাডায় পড়ালেখা করে সেখানে চাকরি করতেন। এরপর তিনি বাড়ি ফিরে হলিধানী বাজারে ব্যবসা করতেন। তার চলাফেরা কট্টর ইসলামী মনোভাবের বলে ছেলে রোজোর সাথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মিল ছিলো না বলেও বাবা খয়বর রহমান জানান।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র সাইফুল ইসলাম মামুনকে পহেলা জুলাই ঝিনাইদহ শহরের পবহাটী গ্রামের টুলু মিয়ার বাড়ি থেকে শাদা পোশাকের লোকজন নিয়ে যায়। ওই বাসায় তিনি ছাড়াও ৬/৭ জন ছাত্র ভাড়া থাকতেন।

মামুনের বাবা লুৎফর রহমান, প্রতিবেশী তপন কুমার ঘোষ ও মামাতো ভাই নাসির উদ্দীন জানান, অনেক খুঁজেও মামুনকে পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে তারা থানায় জিডি করতেও সাহস পায় নি বলে বাবা লুৎফর রহমান জানান। এদিকে অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে মিডিয়ার সাথে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কালীগঞ্জ উপজেলার হরিগোবিন্দুপর গ্রামের নিখোঁজ মিলন হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পরিবারের সবাই আতঙ্কে আছেন। ঘরে এক কোনে গুমরে গুমরে কাঁদছে মা ও বোনেরা। গত ৪ জুন মিলনের সাথে ইসলাম উদ্দীনের ছেলে উজ্জ্বলকে নিয়ে যাওয়া হয়। ফয়লা মোড় থেকে উজ্জ্বলকে ছেড়ে দিলেও ফিরে আসেনি মিলন হোসেন।

কালীগঞ্জ থানার ওসি আমিনুল ইসলাম জানান, নিখোঁজ মিলনকে আটকের বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পাবর্তীপুর গ্রামের উজ্জ্বল সর্দার (৩২) নামের এক মাংস ব্যবসায়ী ৪ দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। গত শনিবার (৯ জুলাই) সবাড়ী থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে চুয়াডাঙ্গার বদরগঞ্জ বাজারে গরু কিনতে যান উজ্জ্বল। বাবা শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, টাকার জন্য প্রতিপক্ষ কোনো ব্যবসায়ী তাকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারে।

হরিণাকুণ্ডু থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহাতাব উদ্দিন জানান, উজ্জ্বল সর্দারের পিতা শহিদুল সর্দ্দার হরিণাকুণ্ডু থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছেন। বিষয়টি অপহরণ নাকি অন্য কিছু তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। শৈলকুপার চরফুলহরি গ্রামের শাহিন হোসেন পরশকে গোসল করার সময় ধরে নিয়ে যায় বলে তার চাচা সিদ্দিকুর রহমান জানান। পরশ ঝিনাইদহ কেসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ম্যানেজমেন্টের ছাত্র। ঝিনাইদহ শহরের চানপাড়ার আজমুল হুদাকে শৈলকুপার ভাটই বাজার থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায় বলে তার বাবা শাহ আলম অভিযোগ করেন। আজমুল হুদা ঝিনাইদহ কেসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বিএসসি (ম্যাথ) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র বলে জানা গেছে। ঘটনার দিন আজমুল তার মাকে আনতে রংপুর যাচ্ছিলেন।

এদিকে ঝিনাইদহ শহরের পাবলিক হেলথ জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন সোহেল রানা (২২) ৪০ দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। গত ৩ জুন শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর একটি কালো রঙের হাইয়েজ গাড়িতে কে বা করা তাকে তুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে তার কোনো সন্ধান নেই।

সোহেল রানার ভাই মাসুদুর রহমান জানান, ঘটনার দিন সোহেল রানার সাথে কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি কথা বলতে দেখা গেছে। এ ঘটনার পর থেকেই সোহেল রানাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের ধারণা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। একের পর এক নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানান, কেও নিখোঁজ হলে আমরা সেই পরিবারকে থানায় জিডি করতে বলেছি। আজবাহার আলী শেখ জানান, জিডি করার পর আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।

ঝিনাইদহ সদর থানার বিদায়ী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসান হাফিজুর রহমান জানান, রোজ নামে তিনি এক যুবককে তিনি হলিধানী বাজার থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন। ছেলেটি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতি। তার মধ্যে খারাপ কিছু পায়নি। এ জন্য তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। বাকি ৮জন নিখোঁজের বিষয়ে তিনি জানান, এ বিষয়গুলো আমাদের কানে এসেছে। পুলিশ তদন্ত করে দেখছে কারা নিয়ে গেছে।

ওসি হাসান হাফিজুর রহমান জানান, দেশের কিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ও হামলার সাথে ঝিনাইদহের অপরাধীরা জড়িত রয়েছে, যেটা আগেই পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে।

তিনি বলেন, ঝিনাইদহের পুরোহিত ও সেবায়েতসহ ভিন্নমতের যারা খুন হয়েছে সব হত্যার মোটিভ ও ক্লু পুলিশ উদ্ধার করতে পেরেছে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশ এখন জেলাব্যাপী মিসিং ও জঙ্গি কানেকশন অনুসন্ধান করছে।