জাকির নায়েক : বিতর্ক যার সঙ্গী

 

স্টাফ রিপোর্টার: জঙ্গিবাদে প্ররোচণার অভিযোগে গতকাল রোববার থেকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়া পিস টিভির মালিক ভারতে জন্ম গ্রহণকারী ইসলামি বক্তা ড. জাকির নায়েককে ঘিরে বিতর্ক-আলোচনা কিংবা সমালোচনা নতুন কিছু নয়। বলা যায় তার জীবনের প্রায় পুরো অংশ জুড়েই রয়েছে এই বিতর্ক। ঢাকার গুলশানে গত ১ জুলাইয়ের জঙ্গি হামলায় জড়িতদের মধ্যে অন্তত দুজন জাকির নায়েকের মতো ইসলামি বক্তাদের অনুসরণ করত বলে অভিযোগ উঠার পর তাকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। যা সারা বিশ্ব ছুঁয়ে এখন বাংলাদেশে। ভারতের মহারাষ্ট্রের চিকিত্সক জাকির নায়েক, যিনি বিভিন্ন সময় ইসলাম ধর্ম, জঙ্গিবাদ, জিহাদ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে নিষিদ্ধ হয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মালয়েশিয়ায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি এ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে থাকেন। আলোচিত ড. জাকির নায়েক অবশ্য বলেছেন, তিনি জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন এমন কোনো অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের কোনো কর্মকর্তা তাকে জানাননি। সৌদি আরব অবস্থানরত জাকির নায়েক গত শনিবার এক ভিডিওবার্তায় বাংলাদেশের সরকার এবং দেশের ভক্তদের বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন। জাকির নায়েক বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে আমার লাখ লাখ ভক্ত। বাংলাদেশের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ আমার ভক্ত। কিন্তু আমি তাকে (এক সন্ত্রাসী) নিরপরাধ মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছি বলাটা নিষ্ঠুর হবে।’ ১৯৬৫ সালে মুম্বাইয়ে জন্ম নেয়া জাকির নায়েক কিষানচাঁদ চেলারাম কলেজের পর টোপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। ১৯৮৭ সালে ইসলামিক বক্তা আহমেদ দিদাতের সংস্পর্শে আসেন নায়েক। এর কয়েকবছর বাদে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করেন ধর্ম প্রচারের কাজ। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে তোলেন ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইআরএফ), এই ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানেই চলে পিস টিভির কার্যক্রম। সুবক্তা হিসেবে পরিচিত জাকির নায়েক তার অসাধারণ স্মরণশক্তির জন্যও খ্যাত। যে কোনো বক্তৃতায় তাকে কুরআন বেদ গীতা কিংবা বাইবেলের যে কোনো পাতা, যে কোনো অংশ থেকে অনর্গল উদ্ধৃত করতে দেখা যায়। বিভিন্ন সময় টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আলোচনায় হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের উপর নিজের দখলের পরিচয়ও দিয়েছেন তিনি। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে। তবে সেই সাথে জঙ্গিবাদের প্রতি তার সমর্থনসূচক বক্তব্যের সমালোচনাও উঠতে থাকে। সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতায় ওহাবি মতবাদ প্রচারকারী হিসেবে জাকির নায়েককে সন্দেহের চোখেও দেখেন অনেক মুসলিম পণ্ডিত। ‘ইসলামের সেবক’ হিসেবে ২০১৫ সালে সৌদি আরব সরকার ‘বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ দেয় জাকির নায়েককে। গত বছর উসকানিমূলক কথাবার্তা বলার অভিযোগে ভারতের কর্নাটক রাজ্যে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও সেই সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছে বলে ইঙ্গিত মিলছে। সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে জাকির নায়েক বলেছেন, সন্ত্রাসীদের ভয় দেখাতে হলে সব মুসলমানকেই টেররিস্ট হতে হবে। ওসামা বিন লাদেন যদি ইসলামের শত্রুদের বিপক্ষে লড়েন, আমি তার পক্ষে আছি। তিনি যদি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসি আমেরিকার বিরুদ্ধে ত্রাস সৃষ্টি করেন, আমি তার পক্ষে আছি। নাইন-ইলেভেন হামলার জন্য আল কায়েদা দায়ী নয়। এমন কি একজন বোকাও বলবে, ওই ঘটনা তারা (যুক্তরাষ্ট্র) নিজেরাই ঘটিয়েছে।

২০১০ সালে ব্রিটেন জাকির নায়েককে নিষিদ্ধ করার তিন বছর পর বিবিসি-তে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, তাকে নিষিদ্ধ করা হলেও ব্রিটেনের লাইব্রেরিতে তার বই রয়েছে। বিবিসির ওই প্রতিবেদনে আরো দাবি করা হয়, লন্ডনের পাবলিক লাইব্রেরিতে জাকির নায়েকের অন্তত এমন তিনটি বই রয়েছে, যেগুলোতে তিনি জঙ্গিবাদ, নারী এবং ইহুদিদের বিষয়ে চরম আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্যে জাকির নায়েক নিজেকে জঙ্গিবাদবিরোধী বলে দাবি করেছেন। এক অনুষ্ঠানে তিনি আইএসের কর্মকাণ্ডের সমালোচনাও করেন। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এই উগ্র সংগঠনটিকে ‘অ্যান্টিইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, কোরআনে বলা আছে, যদি কেউ কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে নিহত ব্যক্তি মুসলিম-অমুসলিম যা-ই হোন না কেন, সেই হত্যা পুরো মানবতাকেই হত্যার শামিল। এখন যারা নিজেদের ‘আইএস’ বলে দাবি করে, তারা নিরপরাধ মানুষকেই তো হত্যা করছে। নিরপরাধ অমুসলিমদের হত্যা করার কথাও কোরআনে বলা নেই। তাই আমার মতে, তারা (আইসিস বা আইএসআইএস বা আইএস) মুসলমানই হতে পারে না। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, আমি তাকে মানুষ খুন করতে উত্সাহ দিয়েছি- এটা বলা শয়তানি। বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থানরত এই ইসলামিক বক্তার ভাষ্য, বিশ্বে একমাত্র যুক্তরাজ্যেই তাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। মালয়েশিয়ায় তাকে নিষিদ্ধ করার খবরও অস্বীকার করেছেন তিনি। এদিকে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের গুলশানে হামলাকারী সন্ত্রাসিদের একজন জাকির নায়েকের বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এমন প্রতিবেদন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই জাকির নায়েক বিভিন্ন দিক থেকে চাপে পড়েছেন।  ভিডিওবার্তায় জাকির নায়েক বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ সরকারের মানুষের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছেন যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসি হামলার মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষ হত্যায় আমি উদ্বুদ্ধ করেছি বলে বিশ্বাস করেন না তারা। সে (এক সন্ত্রাসী) আমার একজন ভক্ত ছিলো, সেটি ভিন্ন বিষয়।’

বিভিন্ন দেশে তাকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে জাকির নায়েক বলেন, ‘আমার জানামতে, যুক্তরাজ্যই একমাত্র দেশ যারা একবার দেশটিতে প্রবেশে আমাকে বাধা দিয়েছিলো। তবে দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে নিষিদ্ধ করেছে এমন কোনো প্রমাণ আমি পাইনি।’ তিনি আরো বলেন, মালয়েশিয়ায় দুটি শীর্ষ পুরস্কার তাকে দেয়া হয়েছে। গত ২৫ বছরে তিনিই চতুর্থ ব্যক্তি যিনি মালয়েশিয়ার কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। জাকির নায়েক প্রশ্ন তোলেন, সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়া কোনো ব্যক্তিকে কি তারা এমন পুরস্কার দিতে পারে?

Leave a comment