দেশ তথা জাতি চরম সঙ্কটময় মুহূর্ত পার করছে। দু দিনের শোক ঘোষণা করেছে সরকার। শুধু দেশবাসী নয়, রাজধানীর গুলশানের রেঁস্তোরায় রক্তের বন্যায় বিশ্বজুড়েই নেমে এসেছে শোকের ছায়া। প্রশ্ন উঠেছে, এই নৃশংসতা চালিয়ে কোন ধর্মের কতোটুকু লাভ হলো? হিসেব কষেই আত্মঘাতী, নাকি চক্রান্তের শিকার? কেন রুখতে পারলাম না আমরা এই প্রাণহানি?
শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বরের আর্টিজান রেঁস্তোরায় অস্ত্রধারীরা অতর্কিত হামলা চালায়। এরপর তারা ওই রেঁস্তোরায় থাকা লোকজনকে জিম্মি করে। হলি আর্টিজান বেকারি নামের ওই রেঁস্তোরায় জঙ্গি হামলার কিছুক্ষণ পর পুলিশের অগ্রগামী দলের দু কর্মকর্তা জঙ্গিদের গুলি ও বোমায় নিহত হন। আহত হন অন্তত ৪০ জন পুলিশ সদস্য। নিহত দু পুলিশ কর্মকর্তা হলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন। হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ২০ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করে। গতকাল সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডদল অভিযান চালায়। নিহত হয় হামলাকারীদের ৬ জন। দেশের সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচিত কূটনৈতিক এলাকায় এই রক্তাক্ত হামলার ঘটনার সাথে সাথে যে প্রশ্নটি উঠে এসেছে তা হলো- কীভাবে জঙ্গিরা এই হামলা চালাতে সাহস পেলো?
একের পর এক খুনের পর আইএস প্রসঙ্গটি যখন উঠে আসে আলোচনায় তখন থেকেই বারবার বলা হচ্ছিলো দেশে আইএস বা আল-কায়েদা নেই। এখানে যারা হামলা করছে, তারা করা? দেশেরই জঙ্গি। সে কারণেই ভয়টা বেশি। তাদের শিকড় কি এতোটাই গভীর যে সরকারের ভাষায় জিরো টলারেন্স দেখানোর পর তারা আরও ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হলো। বিএনপি আমলে সংঘটিত জঙ্গি হামলার ব্যাপারে বলা হতো তাতে সরকারের মদদ ছিলো। কিন্তু এখন কী দোহাই দেবেন ক্ষমতাসীনেরা? বিদেশি নাগরিকদের যাতায়াত আছে-এ রকম স্থানে জঙ্গি হামলা হতে পারে বলে বিদেশি কূটনীতিকেরা অনেক আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তারপরও সরকার কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলো না? গোয়েন্দারা কেন ব্যর্থ হলো আগাম তথ্য সংগ্রহে?
আইএসপিআরের সংবাদ সম্মেলনে দেয়া তথ্য অনুযায়ী জঙ্গিদের হাতে ২০ জন নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ইতালির ৯ জন, জাপানি ৭ জন, ভারতীয় একজন ও বাংলাদেশি ৩ জন। এ হত্যাযজ্ঞে গোটা বিশ্ব কী বার্তা পেয়েছে? তারা এই বার্তাই পেয়েছে যে বাংলাদেশে আর বিদেশিরা নিরাপদ নন। এর আগে গত বছর জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছিলেন দুই বিদেশি নাগরিক। ইতালির সিজার তাবেলা ও জাপানের হোসিও কুনি। সেই হত্যাকাণ্ডের পর সরকার কি জনগণের নিরাপত্তায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? নিয়ে থাকলে একের পর এক গুপ্তহত্যার পর জঙ্গিরা এই প্রকাশ্য হামলার সাহস পেলো কীভাবে? যেসব দেশি ও বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন, আমরা কখনোই তাদের ফিরিয়ে আনতে পারবো না। যে দুই পলিশ কর্মকর্তা সেখানে উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন, তারাও ফিরে আসবেন না। তাদের সবার স্বজনদের প্রতি জানাই গভীর সহমর্মিতা। যদিও কোনো সান্ত্বনা ও সহমর্মিতাই প্রিয়জনহারা মানুষগুলো কষ্ট ও বেদনা লাঘব করবে না। হামলাকারীদের রুখতে গিয়ে শুক্রবার রাতেই যে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আহত হয়েছেন তাদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গার একজন সন্তান রয়েছেন। তিনিসহ সকল আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক।
হামলাকারীদের মধ্যে জীবিত ও নিহতদের পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের সহযোগীদের খুঁজে বের করা দরকার। সকল রাজনৈতিক শক্তি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রকৃত ধর্মের জ্ঞান ছড়িয়ে ধর্মান্ধতা দূর করতে হবে। দেশ, জাতি ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে রাজনৈতিক ঐক্যমতে পৌছুতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন।