স্টাফ রিপোর্টার: শুক্রবার ইফতারের পর প্রকৌশলী হাসনাত করিম ১৩ বছর বয়সী সন্তানের জন্মদিন পালন করতে গিয়েছিলেন হোলি আর্টিজান বেকারি নামে স্প্যানিশ ক্যাফেতে। তার সাথে ছিলেন স্ত্রী শারমিন পারভীন ও আট বছরের আরেক সন্তান। সন্তানদের নিয়ে আনন্দ করার মুহূর্তেই মিয়ে যায় সব। হঠাৎ বোমা-গুলির শব্দ। আতঙ্কে কেঁপে ওঠে বুক। জিম্মি করে ফেলে অস্ত্রধারীরা। শুরু হয় দুঃস্বপ্নের রাত। বারো ঘণ্টা পর দুই সন্তানকে নিয়ে সুস্থভাবে মুক্ত হন হাসনাত দম্পতি। সন্তান হাসনাত, পুত্রবধূ ও দুই নাতি-নাতনিকে পেয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে মা ও বাবা এম আর করিমের। সারারাত ভাই ব্যবসায়ী আনোয়ারুল করিমসহ স্বজনদের নিয়ে হাসনাতের বাবা-মা অপেক্ষায় ছিলেন। তবে এখানো দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটছে না তাদের। শুধু হাসনাত দম্পতি নয়, তাদের মতো বিদেশি নাগরিকসহ আরো কয়েক বাংলাদেশি উদ্ধার পান জিম্মি দশা থেকে।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’-এ শ্বাসরুদ্ধকর ১২ ঘণ্টার জিম্মি সঙ্কটের অবসান ঘটে। মূল অভিযান ছিল মাত্র ১২-১৩ মিনিট। বাকি সময় পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। কর্ডন করে রাখা হয় গোটা এলাকা। রাজধানীর অভিজাত ও কূটনীতিকপাড়া গুলশান দুই নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় হোলি আর্টিজান বেকারি। এই বেকারিতে বিদেশি নাগরিকরাই বেশি যাতায়াত করেন। গুলশান লেকের পাড় ঘেঁষে অবস্থিত এ বাড়ির একই তলায় আরো একটি ‘ও কিচেন’ নামে রেস্টুরেন্ট রয়েছে। পাশেই লেক ভিউ ক্লিনিক। এছাড়া এই সড়কে আছে তিনটি দূতাবাস। নিরাপত্তার মধ্যেই অস্ত্রধারীরা গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হোলি আর্টিজানে ডিনার খেতে যাওয়া গ্রাহকদের জিম্মি করে রাখে। রাতভর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিল গোটা দেশের মানুষ।
পুলিশ, ৱ্যাব ও প্রত্যক্ষদর্শীসূত্র থেকে জানা গেছে, শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে অস্ত্রধারী ৭-৮ যুবক গুলি করতে করতে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে আল্লাহু আকবর বলতে থাকে। এরপর বন্ধ করে দেয়া হয় ক্যাফের ফটক, লাইট (আলো) ও সিসিটিভি। তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে রেস্টুরেন্টে থাকা লোকজনকে। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন বিদেশি নাগরিক। খবর পেয়ে গুলশান থানার টহল পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও সন্ত্রাসীদের গুলির মুখে ফিরে যায়। রেস্টুরেন্টের ক্যাশিয়ার সুমন পারভেজসহ কয়েক কর্মচারী এবং দেশি-বিদেশি কয়েকজন গ্রাহক পেছনের দরজা ও ছাদ দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।
এরপর রাত সাড়ে ৯টার দিকে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশসহ পুলিশ অভিযান চালায়। এ সময় হোলি আর্টিজান থেকে সন্ত্রাসীরা গুলি ও গ্রেনেড ছুড়ে মারলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২০ জনেরও বেশি পুলিশ ও ৱ্যাব সদস্য আহত হন। এ সময় পুলিশও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে এবং পাল্টা গুলি চালালে জিম্মিদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় অভিযান থেকে পিছু হটে পুলিশ। এরপর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ছুটে যায় পুলিশ, ৱ্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (ৱ্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ডিএমপির বিশেষায়িত সোয়াত টিম, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিপুল সদস্য। ঘটনাস্থলসহ আশপাশ ঘিরে ফেলেন তারা।
গোটা গুলশান, বারিধারা, বনানী এলাকায় যানবাহন চলাচলও সীমিত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য। এ সময় ঘটনাস্থলের আশপাশে ভিড় জমান গণমাধ্যম কর্মী ও জিম্মি থাকাদের স্বজনরা। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে জিম্মি সঙ্কটের ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার হলে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ৱ্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ প্রাণহানি রোধ ও কাজের সুবিধার্থে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের অনুরোধ করেন এবং সাংবাদিকদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দেন। মূলত এর পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি সম্পর্কে কোনো তথ্য পাচ্ছিলেন না সাংবাদিক কিংবা জিম্মিদের স্বজনরা। এরই মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দফায় দফায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মী, বিভিন্ন সরঞ্জাম, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সাঁজোয়া যান, অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে থাকে ঘটনাস্থলের পাশে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ৱ্যাবের একটি হেলিকপ্টার এলাকায় মহড়া দেয়। রাত সোয়া ১১টার দিকে ডিবির সিনিয়র সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন খানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে উদ্বেগ বাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। রাত ১টার দিকে ঘটনাস্থলের দিক থেকে বোরকা পরা একজনকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
পুলিশ জানিয়েছে, এর আগে হামলার পর রেস্টুরেন্টের বিদেশি শেফ দিয়াগো স্টেইন ও বাঙালি কর্মী বেলারুশকে উদ্ধার করা হয়। তবে তারা কীভাবে জিম্মি দশা থেকে উদ্ধার পেলেন তার বিস্তারিত জানাননি তারা। রেস্টুরেন্টে অস্ত্রধারীদের হামলার পর ঠিক কতজন সেখানে আটকা পড়েছেন, এর মধ্যে কতজন বিদেশি, কতজন বাংলাদেশি, কতজন রেস্টুরেন্টের স্টাফ তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি কোনো সূত্রেই। রাত সোয় ১টার দিকে নেভাল কমান্ডো এবং ২টার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। রাতভর ৱ্যাবের ডিজি ও ডিএমপি কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবস্থান করেন। প্রস্তুতি নেয়া হয় অভিযানের। তবে ভোর রাত ৪টার দিকে কমান্ডো অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হয়। শনিবার ভোর ৫টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথবাহিনী অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি নেয়। যৌথ অভিযানে সেনাবাহিনী, পুলিশ, ৱ্যাব, বিজিবি, নৌবাহিনীর কমান্ডো এবং বিশেষ বাহিনী সোয়াত অংশ নেয়। সকাল ৭টার দিকে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো ফোর্স। আশপাশের ভবনের ছাদে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল আর টেলিস্কোপ লাগানো স্নাইপার রাইফেল নিয়ে অবস্থান নেন কমান্ডোরা। অভিযান শুরুর আগে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রধানরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) সংবাদ সম্মেলনে জানায়, সকাল পৌনে ৮টায় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ শুরু করে যৌথ বাহিনী। ১২-১৩ মিনিটের মধ্যে সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে টার্গেট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাড়ে ৮টায় অভিযানের সফল সমাপ্তি ঘটে। তিন বিদেশিসহ ১৩ জনকে জীবিত এবং ২০ জিম্মির লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ৬ সন্ত্রাসী নিহত ও এক সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা হয় সন্ত্রাসীদের ব্যবহƒত চারটি পিস্তল, একটি ফোল্ডেড বাট একে-২২, চারটি অবিস্ফোরিত আইইডি, একটি ওয়াকিটকি সেট ও ধারালো দেশীয় অস্ত্র।
অভিযানের সময় প্রবল গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সোয়া ৮টার দিকে রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। তাদেরকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সাড়ে ৮টার দিকে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সঙ্কটের অবসান ঘটে ১২-১৩ মিনিটে। সাড়ে ৯টার দিকে গুলশান এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যান পুলিশ মহাপরিদর্শক। কমান্ডো অভিযানের মধ্যেই ডিএমপির উপ-কমিশনার (চ্যান্সেরি) জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, জিম্মিদের একজন একজন করে উদ্ধার করা হচ্ছে। জিম্মি সংকট শুরু থেকে অভিযান শেষ হওয়া পর্যন্ত এলাকায় ছিল ভীতিকর পরিস্থিতি, যা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশেই। ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসিন্দারা অনেকেই আটকা পড়েন বাইরে। সারারাত বাইরেই কাটাতে হয়। যারা বাড়িতে ছিলেন তাদের মধ্যে ছিল আতঙ্ক। কোনো কোনো বাড়িতে বারান্দায় সারারাত বসে থাকতে দেখা গেছে বাসিন্দাদের।
একটি ভবন থেকে অভিযান দেখা দুই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সকাল সোয়া ৮টার পর দুটি জলপাইরঙা সেনা সাঁজোয়া যান হোলি আর্টিজান বেকারির সীমানা দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সাদা আরেকটি সাঁজোয়া যান ছিলো রাস্তায়। পরে অভিযানে যুক্ত হয় আরো তিনটি জলপাই রঙের সাঁজোয়া যান। সাঁজোয়া যান ক্যাফে কম্পাউন্ডে ঢোকার সময় এর বাইরের দিকে থাকা পিৎজা কর্নার এবং লাগোয়া লেক ভিউ ক্লিনিকের গাড়ি পার্কিংয়ে রাখা দুটি গাড়ি গুঁড়িয়ে যায়। বিকট শব্দে বাজছিল একটি গাড়ির অ্যালার্ট সিস্টেম। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া হলি বেকারির সবুজ লনে তৎপর দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বহনযোগ্য ছোট অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ছুটে যেতে দেখা যায়।
অভিযান শেষে ক্যাফের পাশের বহুতল ভবনটির গ্যারেজে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে কয়েক যুবককে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে শুইয়ে রাখতে দেখা যায়। তবে তারা কারা সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। বেকারির পেস্ট্রি শেফের পোশাক পরা একজনের সাথে কয়েকজনকে একটি মাইক্রোবাসেও তুলতে দেখা যায়।
এরই মধ্যে ১০ ঘণ্টা অপেক্ষার পর সকাল সোয়া ৭টার দিকে জিম্মিদের অভিভাবক ও স্বজনরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা বলতে থাকেন, এত লম্বা সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো খবর পাচ্ছেন না। তাদের কিছু জানানো হচ্ছে না। তারা অন্ধকারে আছেন। এ সময় ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় ও আবদুল বাতেন বিক্ষুব্ধ স্বজনদের নিবৃত্ত করেন।
অভিযানে উদ্ধার হওয়া প্রকৌশলী হাসনাতকে কাছে পেয়ে মা কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, সন্তান, পূত্রবধূ ও নাতনিদের জন্য স্বামী এমআর করিমকে সঙ্গে নিয়ে সারারাত গুলশানে ছিলেন।
এখনো ৭৯ নম্বর সড়কসহ ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এলাকার বাসিন্দা ও চাকরিজীবীদের হেঁটে চলাচল করতে হচ্ছে। যানবাহন ঢুকতে-বের হতে দেয়া হচ্ছে না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ক্রাইম সিন ইউনিট কাজ করছে ঘটনাস্থলে।