স্টাফ রিপোর্টার: কারাগারের ভেতরে-বাইরে সশস্ত্র হামলা; কারারক্ষী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও স্পর্শকাতর মামলার আসামিদের জিম্মি এবং দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের কারাগার থেকে পালানোর পথ করে দেয়াসহ নানা কৌশলে একটি কুচক্রীমহল কারা নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চাইছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যেই তারা কারা অভ্যন্তরে কয়েকদফা ষড়যন্ত্র বৈঠক করেছে। বাইরে থেকে একাধিক শক্তিশালী গোষ্ঠী তাদের ইন্ধন দিচ্ছে। নানা পরিচয়ে বহিরাগত সহযোগীরা কারা অভ্যন্তরে ঢুকে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে এ ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে আসছে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন পর্যবেক্ষণে এর বেশকিছু তথ্য ফাঁস হওয়ার পর দেশের কারাগারগুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে দেশের অধিকাংশ কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যথেষ্ট নাজুক বলে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে বহিরাগতদের দেখা-সাক্ষাৎ পর্ব এবং তাদের আদালতে আনা-নেয়ার ব্যবস্থাতে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটলে তা সামাল দেয়া কারারক্ষীদের পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে বলে গোয়েন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে একাধিক রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে কোনো উল্লেখ করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির বলেন, কারাগারে রেড অ্যালার্ট নয়, হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। কারাগারের বাইরে নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ নির্দেশনা জারি করেছে। তবে কারা অভ্যন্তরেও যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় এজন্য তারা সতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে এক সেলের কয়েদিরা যাতে অনুমতি ছাড়া অন্য সেলে গিয়ে সেখানকার বন্দিদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে না পারে এজন্য কারারক্ষীদের সর্বোচ্চ সতর্ক করা হয়েছে। এ নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে জেলকোড অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হুশিয়ার করেছে।
এদিকে গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, গত কয়েকদিনে একাধিক চক্র ঢাকা, খুলনা, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলসহ বেশ কয়েকটি কারাগারের চারপাশে রেকি করে গেছে বলে তারা তথ্য পেয়েছে। একই চক্র নিকটাত্মীয়-স্বজন পরিচয়ে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারসহ অন্তত অর্ধডজন কারাগারে ঢুকে টপ টেররদের সঙ্গে দেখা করে গেছে। অথচ এ সময় কারা কর্তৃপক্ষ সতর্কতার সঙ্গে তাদের নাম-পরিচয় ও ঠিকানা যাচাই করেনি। এমনকি তাদের দেহ তল্লাশির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট দুর্বলতা ছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ধরনের নাজুক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জঙ্গি বা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পক্ষে কারা অভ্যন্তরে বড় ধরনের হামলা চালানো সহজ বলে গোয়েন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
এদিকে কারা নিরাপত্তার দুর্বলতার কথা খোদ কারা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, সাধারণ সময়েই কারাগারে ধারণ ক্ষমতার দেড় থেকে প্রায় দ্বিগুণ বন্দি থাকে। এর ওপর বিশেষ অভিযানে ব্যাপক ধরপাকড়ে এর সংখ্যা তিনগুণের কোটা ছুঁয়েছে। এতে কারা অভ্যন্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও বিশেষ মহলের সহযোগিতায় কারা বন্দি টপটেরররা অনেকটা স্বাধীনভাবে জেলখানায় চলাফেরা করছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হাই সিকিউরিটি সেল না থাকলেও তাদের অন্তত পাঁচজন সেখানে সাধারণ সেলে রয়েছে। এদের কেউ কেউ আবার অসুস্থতার অজুহাতে কারা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নির্বিচারে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অন্যদিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের হাই সিকিউরিটি সেলে দুর্ধর্ষ জঙ্গিরাও কতোটা নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রয়েছে তা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। গোয়েন্দাদের ভাষ্য, কারা ষড়যন্ত্রের যে আভাস তারা পেয়েছেন এখনই দ্রুত সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তা সফল করা ষড়যন্ত্রকারী চক্রের পক্ষে খুব বেশি কঠিন হবে না। এদিকে কারাবন্দি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন, জঙ্গি সদস্য ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাছে বাইরে থেকে আসা খাবার ও চিঠিপত্র যেভাবে অসতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভেতরে পাঠানো হয় তাতেও বড় ধরনের ঝুঁকি রয়ে গেছে বলেও গোয়েন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘কারাগারে মাঝারি সাইজের টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার পাঠানো একেবারেই ডাল-ভাত। আর ওই খাবারের ভেতরে লুকিয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির শক্তিশালী বিস্ফোরকও পাঠানো সম্ভব। তাই তারা এ ব্যাপারে কারা অধিদপ্তরকে সতর্ক হওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে বলে জানান ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। গোয়েন্দারা জানান, ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও তারা নানাভাবে তথ্য সংগ্রহ করে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এমনকি কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের চিঠি-পত্রও তদারকিতে যথেষ্ট ঘাটতি থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেন গোয়েন্দারা।
অন্যদিকে কারাগারের প্রবেশ পথসহ আশপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতোটা শক্তিশালী তা ২৫ এপ্রিল গাজীপুর কাশিমপুর কারাগারের মূল ফটকে সদ্য অবসরে যাওয়া এক কারা কর্মকর্তা এবং ২০ জুন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের পাশে হেমায়েত নামে সদ্য কারামুক্ত এক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যার ঘটনা দুটো থেকে সহজেই প্রমাণ মেলে।
গোয়েন্দাদের দাবি, কারাগারের সামনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকলে এ দুটো ঘটনা ঘটা সম্ভব হতো না। আর কোনোক্রমে তা ঘটানো সম্ভব হলেও কিলারদের পালিয়ে যাওয়া কঠিন হতো। কিন্তু দুটো ঘটনাতেই খুনিরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেছে। এতে কারা ফটক এবং এর চারপাশের নাজুক নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিত্র সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, আলোচিত কোনো রাজনৈতিক নেতা জামিনে মুক্ত হওয়ার পর কারা ফটকে খুন কিংবা হামলার শিকার হলে তার দায় সরকারের ঘাড়ে এসে পড়বে। স্পর্শকাতর এ ইস্যুতে দেশ উত্তাল হয়ে উঠবে। ষড়যন্ত্রকারীরা এ টার্গেট নিয়েও দেশের বিভিন্ন কারা ফটক কিংবা আশপাশের এলাকায় ওত পেতে থাকতে পারে। তাই এ ধরনের ষড়যন্ত্র রোধে সরকারকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার সুপারিশ করেছে গোয়েন্দারা।
তবে অন্য একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কারাগারের বাইরে নয়, কারা অভ্যন্তরেই আক্রমণ করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই ছক কষেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। দলে ভিড়িয়েছে আফগান ফেরত শতাধিক অভিজ্ঞ যোদ্ধা। প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রায় নিষ্ক্রিয় একাধিক গোষ্ঠী নেপথ্যে তাদের অর্থের জোগান দিচ্ছে। এ ছাড়া পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, তেহরিক তালেবান, কাশ্মিরি মুজাহিদ, হামজা ব্রিগেড ও আরাকানের রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের একটি অংশ এ ষড়যন্ত্রে জড়িত বলে গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছে।