রোয়ানুর তাণ্ডবে ভাসলো উপকূল : ২৬ জনের প্রাণহানি

স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে উপকূল। শনিবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পাওয়া খবরে ২৬ জন নিহতের কথা জানা গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১২ জন, কক্সবাজারে ৩ জন, নোয়খালীতে ৩ জন, লক্ষীপুরে ১ জন, ফেনীতে ১ জন, ভোলায় ৪ জন ও পটুয়াখালীতে ১ জন নিহত হন। এছাড়া উপকূলীয় ১৮ জেলায় নানাভাবে আহত হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৩০ জন। জোয়ারের পানি, প্রবল বর্ষণ ও বাঁধ ভেঙে জেলাগুলোর বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। এসব এলাকায় ভেঙে পড়েছে শ শ ঘরবাড়ি ও গাছপালা। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মাঠের ফসলের। ভেসে গেছে মাছের ঘের। ঝড় শুরুর আগেই বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। কোথাও কোথাও প্রচণ্ড বাতাসে তার ছিঁড়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ঘূর্ণিঝড়টি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে গতকাল শনিবার রাত আটটা নাগাদ দেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামের দিকে চলে যায়। সাগর শান্ত রয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়টির সাথে আসা মেঘের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আগামীকালও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। ঝোড়ো হাওয়া ও ভারী বর্ষণের আশঙ্কায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর এবং কক্সবাজারকে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, রোয়ানু ছিল একটি ছোট সাইক্লোন। বাতাসের গতি বেশি থাকলে এর প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মাহমুদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, প্রবল বৃষ্টি ঝরায় ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এর কারণে যতোটা ক্ষতি হতে পারতো, ততোটা হয়নি।

চট্টগ্রাম: দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে রোয়ানু। এতে কমপক্ষে ১২জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের জঞ্জল সলিমপুরে গাছচাপায় শনিবার ভোররাতে মা কাজল বেগম (৫০) ও তার ছেলে মো. বাবু (১০) নিহত হয়েছেন। নিহতরা ওই এলাকার মো. রাফিকের স্ত্রী ও ছেলে। চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর এলাকায় বেলা ১২টার দিকে আম কুড়াতে গিয়ে ভবন থেকে ইট পড়ে রাকিব (১১) নামে এক শিশু মারা যায়। এছাড়া হালিশহরে নিহত হন দুজন। তবে এখনও তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত খবর পাওয়া যায়নি। বাঁশখালী উপজেলায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৭-৮ ফিট উচ্চতায় সাগরের পানি প্রবাহিত হয়। বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা, আলোকদিয়া, খাটখালী, গন্ডামারা বাজার, প্রেমাশিয়া, ছনুয়া ও খুদুকখালি এলাকায় পানি প্রবেশ করে। এতে কমপক্ষে সাত জন নিহত হন। প্রেমাশিয়া ইউনিয়নের রোষাঙ্গিপাড়ায় পানির স্রোতে মাটির ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে আবু সিদ্দিক নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। এখানে জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় চার শিশু মোহাম্মদ হোসেন (৭), জালাল (৩), জান্নাতুল মাওয়া (৪), শাহেদা বেগম (৩)। এ সময় জালালের দাদি বুলু আখতারও ভেসে যান। পরে তাদের কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করা গেছে। এছাড়া ছনুয়া ইউনিয়নের খুবুতখালী গ্রামে জোয়ারের পানিতে ভেসে যান হারুনের স্ত্রী তাহেরা বেগম। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

কক্সবাজার: কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলায় ঝড়ের সময় তিনজন মারা গেছেন। তারা হলেন- উপজেলার উত্তর ধুরুং এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে মো. ইকবাল (২৫), উত্তর কৈয়ার বিল এলাকার ফয়েজুর রহমানের ছেলে ফজলুল হক (৫৫)। এছাড়া শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পানিতে ডুবে শফিকুর রহমান নামের এক যুবক মারা গেছে বলে নিশ্চিত করেন কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী । এক ব্রিফিংয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক জানান, ইকবাল দেয়াল চাপায় এবং ফজলুল নৌকার ধাক্কায় নিহত হয়েছেন। তিনি জানান, ঝড়েরর সময় আহতদের মধ্যে দুজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পাঁচজনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। বাকি তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক আরও জানান, ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার সাড়ে ২৮ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ কোথাও আংশিক ও কোথাও সর্ম্পূণ ধসে গেছে।

নোয়াখালী: ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র প্রভাবে শনিবার বিকালে প্রবল জোয়ারে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় মা ও মেয়েসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মো. মইন উদ্দিন। তিনি জানান, নিহতরা হলেন- ২নং চানন্দী ইউনিয়নে নলের চর আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেমের স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৫) ও তার মেয়ে মরিয়ম নেছা (১০)  এবং জাহাজমারা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে চরহেয়ার গ্রামের সালাউদ্দিন ব্যাপারীর স্ত্রী মাহফুজা বেগম (৪৭)।

লক্ষ্মীপুর: ঘূর্ণিঝড়ের গাছ উপড়ে পড়ে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় উত্তর তোওয়ারিগঞ্জ এলাকায় আনোয়ার উল্লাহ (৫৫) নামে একজন নিহত ও আরও একজন আহত হয়েছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাজ্জাদুর হাসান জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতের পরিবারকে ৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়বে বলে জানানও  সাজ্জাদুর হাসান।

ফেনী: ঘূর্ণিঝড়ের সময় ফেনীর  সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া  এলাকায়  চর থেকে মহিষ আনতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে নুরুল আলম (৩৫) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন বলে জানান সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফা হক। এছাড়াও অজ্ঞাতনামা দুজন নিখোঁজ রয়েছেন।

ভোলা: ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ে ভোলায় চারজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তজুমদ্দিন উপজেলায় ঘরচাপায় নারীসহ দুজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক লোকজন। ঝড়ে উপজেলার বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট বিধ্বস্ত হয়েছে। নিহতরা হলেন- উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের শশীগঞ্জ গ্রামের নয়নে স্ত্রী রেখা বেগম (৩৫) ও একই এলাকার মো. মফিজের ছেলে আকরাম (১৪)। দুজনের বাড়ি  উপজেলার শশীগঞ্জ গ্রামে। ঝড়ে দৌলতখান উপজেলার দক্ষিণ জয়নগর ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রানু বেগম (৫৫) নিহত হয়েছেন। তিনটি কার্গোডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন আটজন। ভোলার মনপুরায় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে সামিয়া (৩ দিন) নামে এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। সে উপজেলার উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়নের আর্দশ গ্রামের তসলিমের মেয়ে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় ওই নবজাতকের মৃত্যু হয় বলে জানান ইউপি সদস্য মো. সোহেল। এছাড়াও রোয়ানুর আঘাতে ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে ৫-৬ ফুট জোয়ারে পানি প্রবেশ করে। এতে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়।

পটুয়াখালী: পটুয়াখালীর দশমিনায় ঘূর্ণিঝড়ে শনিবার সকালে নয়া বিবি (৫২) নামে এক গৃহবধূ ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরচাপায় নিহত হয়েছেন। তিনি উপজেলার উত্তর লক্ষ্মীপুর গ্রামের সুন্দর আলীর স্ত্রী। জেলার রাঙ্গাবালী ও গলাচিপা উপজেলায় বেশকিছু কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

নোয়াখালী: হাতিয়ার সানন্দী ইউনিয়নের আদর্শ গ্রামে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যান মিনারা বেগম ও তার মেয়ে মরিয়ম উন নেছা। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। হাতিয়া থানার ওসি একেএম নাসিরুল হক জানান, মেঘনা নদীর তীর থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঝড়ে দুই শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। জোয়ারের পানিতে ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আহত হয়েছেন ২০ জন।