অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা কার্যকর হোক

হঠাৎ করেই সরকার ঘোষণা দিলো, প্রাথমিক শিক্ষা এখন থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাবিদসহ আরও অনেকেই এই দাবি তুলছিলেন, ফলে সরকারের এ সিদ্ধান্ত আমাদের কাঙ্ক্ষিতই ছিলো। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ একই কথা বলা হয়েছিলো। কিন্তু সিদ্ধান্তটি নেয়ার আগে এ নিয়ে সমাজে তেমন আলোচনা ছিলো না। সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। আবার সরকার এ ব্যাপারে একেবারেই প্রস্তুতি নেয়নি, সে কথা বলা যাবে না। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’র আলোকে প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিটি উপজেলায় ও থানায় একটি করে মোট ৫১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করা হয়। পরের কয়েকটি বছরে আরও অনেক বিদ্যালয়েই ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করা হয়। কিন্তু অবকাঠামোর অপ্রতুলতা ও প্রশাসনিক নানা সমস্যার কারণে সরকারে এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা তেমন একটা সফল হয়নি বলেই জানা গেছে। এর সাথে সিলেবাস তো আছেই। এখন ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সিলেবাস প্রণয়ন করা হয় মাধ্যমিক শিক্ষার দর্শনের আলোকে, এরপর সেটা প্রাথমিক শিক্ষার দর্শনের আলোকে করতে হবে।

যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করা হয়েছিলো, সেখানকার শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। আবার সেখানে বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের প্রয়োজনীয় পদও সৃষ্টি করা হয়নি। সেসব স্কুলে রয়েছে আসবাবপত্রের অভাব। এ রকম হাজারো সমস্যার মধ্যদিয়ে সরকারের এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। কিন্তু সেগুলো মেটানোর আগেই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। এর আগে আমরা দেখেছি, সরকার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি না নিয়েই সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। যদিও সেটা আমাদের অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত ছিলো। কিন্তু দেখা গেলো, এ প্রস্তুতির অভাবের কারণে সৃজনশীল ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই ব্যাহত হচ্ছে। সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু হলে ছাত্রদের মুখস্থ করার মতো নিদারুণ পণ্ডশ্রম করতে হবে না। ধাপে ধাপে নম্বর প্রদানের ব্যবস্থা থাকায় তাদের মূল বিষয়টি ধরতে পরালেই চলবে। ফলে কোচিং নির্ভরতা কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং উল্টো ফল হয়েছে। শিক্ষকেরা সৃজনশীলভাবে পড়ানোর উপযুক্ততা অর্জন করেননি বলে ছাত্রদের এখন আরও বেশি করে কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে হচ্ছে। এমনকি এসএসসি পরীক্ষায় গাইড বই থেকেও প্রশ্ন তুলে দেয়া হচ্ছে।

কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা সরকারের যে সিদ্ধান্তের জন্য সবচেয়ে বেশি ভুগছে তা হলো, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার পর এই পরীক্ষা দিতে হয়। এরপর আবার অষ্টম শ্রেণিতে দিতে হয় জেএসসি পরীক্ষা। এরপর এসএসসি। অথচ আগে যারা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দিতো, তাদের ছাড়া অন্যদের অতিরিক্ত পরীক্ষা দিতে হতো না। এ দুটি পরীক্ষা চালু করার কারণে ছাত্রছাত্রীদের সারাদিন দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। পড়াশোনার চেয়ে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়াই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কারণে এখন স্বাভাবিকভাবেই এ দুটি পরীক্ষা থাকবে না। যেকোনো একটি থাকবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি।

নতুন দিনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য আমাদের শিক্ষার ওপর বেশি জোর দিতে হবে। যার কেন্দ্র হওয়া উচিত প্রাথমিক শিক্ষা। কারণ ছোট বয়সে যদি শিক্ষার ভিতটা শক্ত করে গড়া না যায়, তাহলে বড় হয়ে তারা ভালো কিছু করতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। অথচ আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে যতোটা ভাবিত, প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ততোটা নয়। এমনকি যেসব বামপন্থি ছাত্রসংগঠন শিক্ষা নিয়ে কিছু কথা বলে, তারাও মূলত উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রিক! অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সে কারণেই হয়তো বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা টপ হেভি, অর্থাৎ মাথাভারী। মোদ্দাকথা হচ্ছে, সৃজনশীল ব্যবস্থার মতো সরকারের এই প্রচেষ্টাও মুখ থুবড়ে পড়ুক, তা কাম্য নয়। সেটা হলে সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতির জন্যই তা দুর্ভাগ্যজনক হবে। এখনো সময় আছে, সরকারের উচিত, জোর কদমে প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। আর সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়েই সেটা করতে হবে।

Leave a comment