দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় নতুন সংযোজন বজ্রপাত

বজ্রপাতে ১৫ জেলায় আরও ২৪ জনের মৃত্যূ

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় নতুন সংযোজন বজ্রপাত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সম্প্রতি কয়েক বছরে যে হারে বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বাংলাদেশ বজ্রপাত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। গবেষণায় উঠে এসেছে ঝড় ও বজ্রঝড়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটছে বাংলাদেশে। তাদের মতে, সাম্প্রতিকালে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বায়ু দূষণ। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও এটি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে গত ১০ বছরের বাংলাদেশে মারা গেছে সাড়ে চার হাজারের বেশি মানুষ। বছরে গড়ে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। এপ্রিল-মে মাসে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। এ সময়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারের ৪০টির বেশি বজ্রপাত হচ্ছে। তাদের মতে, বর্তমানে বজ্রপাত বিধ্বংসী রূপ নিচ্ছে। ফলে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটেছে। বজ্রপাত দেশে বর্তমানে একটি দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। গতকাল শুক্রবার দেশের বিভিন্নস্থানে বজ্রপাতে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমীনের চাচাতো ভাইসহ বজ্রপাতে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের ১৬ জেলায় এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতে গতপরশু ৪১জনের মৃত্যুর ঘটনার পর গতকাল শুক্রবার রাত ১১টায় এ রিপোর্ট  লেখা পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে গত দু দিনে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে শুক্রবার ১৫ জেলায় ২৪ জন ও বৃহস্পতিবার ৪১ জন মারা গেছে। এছাড়া শুক্রবার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বৃহস্পতিবার আহতদের মধ্যে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে শুক্রবার পাবনায় ৪ জন এবং নওগাঁ, জয়পুরহাট, টাঙ্গাইল ও গাইবান্ধায় ২ জন করে মারা গেছে। এছাড়া ঢাকার সাভার ও ধামরাই, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ির গোয়ালন্দ, চাঁদপুর, মাগুরা, যশোর, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর, কিশোরগঞ্জের তাড়াইল, নারায়ণগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মারা গেছে একজন করে। চুয়াডাঙ্গায় গতরাতে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্র ছিলো যশোরে ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বোনিন্ম  ঈশ্বরদীতে ২১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সর্বোচ্চ তাপামাত্র ছিলো ৩৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন,

সাভার ঢাকা:  বজ্রপাতে মন্টু মিয়া (১৭) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছে আরো দুই কিশোর। গতকাল শুক্রবার দুপুরে সাভারের ছায়াবিথী হাউজিং সোসাইটির বালুর মাঠে এ ঘটনা ঘটে। মন্টু মিয়া মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানার বড় লালপাড়া গ্রামের মো. হোসেন আলীর ছেলে।

স্থানীয়রা জানায়, দুপুরে বৃষ্টির মধ্যে ছায়াবিথী হাউজিং সোসাইটির বালুরমাঠে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলছিলো মন্টু মিয়া। এ সময় বজ্রপাতে মন্টুসহ ৩ কিশোর আহত হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মন্টু মিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অন্যদেরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

ধামরাই: ধামরাইয়ের বাস্তা নয়াচর গ্রামে শুক্রবার বজ্রপাতে মনির হোসেন নামে এক যুবক আহত হন। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রাম: সাবেক মন্ত্রী আফছারুল আমীনের চাচাতো ভাই আমজাদ আলী (২৯) বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে পাহাড়তলী থানার বারুণী ঘাট বেড়িবাঁধ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া সম্পাদনের কাজ চলছে বলে জানান পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রণজিৎ কুমার বড়ুয়া।

নওগাঁ: জেলার পোরশা উপজেলার নিতপুর দীঘিপাড়া ও মহাদেপুর উপজেলার ধঞ্জইল গ্রামে বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন-পোরশার নীতপুর দীঘিপাড়া গ্রামের ইব্রাহীম হোসেন (১৪) ও মহাদেপুর উপজেলার ধঞ্জইল গ্রামের সচীন মুহুরী (৬০)। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে এসব ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়রা জানায়, সকালে ঝড়-বৃষ্টির সময় ইব্রাহীম বাড়ির পাশে একটি বাগানে আম কুড়াতে গেলে বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এছাড়া মহাদেবপুরের ধঞ্জইল গ্রামে মাঠে বজ্রপাতে মারা যান সচীন মুহুরী। নওগাঁ সদর আধুনিক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. মাহফুজার রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জয়পুরহাট: সদর ও ক্ষেতলাল উপজেলায় বজ্রপাতে মারা গেছে দুইজন। শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়রা জানায়, জেলার সদর উপজেলার সতিঘাটা মাঠে রফিকুল ইসলাম (৩০) ও ক্ষেতলাল উপজেলার হাওরবিলের মাঠে মানিক মিয়া (৩৮) বজ্রপাতে মারা যায়। এ সময় তারা জমিতে কাজ করছিলেন।
গাইবান্ধা: সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের খোদ্দমালিবাড়ী পূর্বপাড়া গ্রামে সিরাজুল হক (৬০) নামে এক ব্যক্তির বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বাদল জানান, সিরাজুল হক সকালে জমিতে কাজ করতে যাওয়ার সময় বজ্রপাতে মারা যান। এছাড়া দুপুরে পলাশবাড়ী উপজেলার বেতকাঁপা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে রেজাউল করিম (৫০) বজ্রপাতে মারা যান।

স্থানীয়রা জানায়, রেজাউল করিম বাড়ির পাশের মাঠে গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন। এ সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

গোয়ালন্দ রাজবাড়ি: শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে গোয়ালন্দে বজ্রপাতে সুবাহান সরদার (৪৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। উজানচর ইউপির ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য নিখিল চন্দ্র রায় জানান, সোবহান সরদার ঝড়-বৃষ্টির সময় বাড়ির সামনে পাট ক্ষেতে কাজ করছিলেন। এ সময় বজ্রপাত হলে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া একই সময়ে উপজেলার ভাগুলপুর গ্রামে বজ্রপাতে ৩ জন আহত হন। তারা হলেন-জেয়াসমিন মজার (২৫),পিয়া বেগম (১৮) ও আ. খলিল শেখের ২০ মাস বয়সের ছেলে আপন। তাদের গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

চাঁদপুর: চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে বালুভর্তি কার্গো জাহাজে বজ্রপাতে নবির হোসেন (২৫) নামের এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। চাঁদপুর সদর মডেল থানার ওসি মো. মামুনুর রশিদ জানান, নবীর হোসেন জাহাজের লস্করের দায়িত্ব পালন করতো। বজ্রপাতের  সময় তিনি জাহাজের সামনের দিকে ছিলেন।

মাগুরা: সদর উপজেলার কাপাসহাটী গ্রামে বজ্রপাতে তুহিন শেখ (২২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। তুহিনের বাবা হেলাল শেখ জানান, বিকেলে কাপাসহাটি গ্রামের নিজ বাড়ির পাশে তুহিন বজ্রপাতে আহত হয়। পরে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

যশোর: যশোরে বজ্রপাতে ইয়ার আলী (৭০) নামে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন তার স্ত্রী আলেয়া বেগম (৬৫)। শুক্রবার বিকেলে শহরতলীর সুজলপুরে এ ঘটনা ঘটে।

ইয়ার আলীর ছেলে ইউনুচ আলী জানান, বিকেলে বৃষ্টি শুরু হলে বাড়ির পাশের মাঠ থেকে তার বাবা গরু আনতে যান। কিন্তু চারটি গরু তিনি একা সামাল দিতে না পারায় তার মা আলেয়া বেগম সহযোগিতা করতে যান। এসময় বজ্রপাতে তারা দুজনে মারাত্মক আহত হন। তাদের উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে তার বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।  মা আলেয়া বেগম চিকিৎসাধীন আছেন। এদিকে, শহরের বারান্দিপাড়া এলাকায় বজ্রপাতের ঘটনায় আলাউদ্দিন বিশ্বাসের স্ত্রী নাজমা বেগম (৪৫) আহত হয়েছেন। তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে শুক্রবার সকালে বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- আনিসুর রহমান ও মোকলেছুর রহমানের মেয়ে লিমা।

স্থানীয়রা জানায়, উপজেলার খড়ক গ্রামের আনিসুর রহমান জমি থেকে ধানের বোঝা আনার সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। একই ঘটনায় পৌরসভার পলিশা এলাকার মোকলেছুর রহমানের মেয়ে লিমার মৃত্যু হয়। ভূঞাপুর থানার ওসি ফজলুল কবির বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জগন্নাথপুর সুনামগঞ্জ: উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের কামারখাল গ্রামের আমির আলী (২৫) বজ্রপাতে মারা গেছে। শুক্রবার সকালে আমির আলীর বাড়ির সামনের একটি মাঠে ধান শুকানোর কাজ করছিলেন। হঠাৎ বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

তাড়াইল কিশোরগঞ্জ: উপজেলার ধলাপাড়া গ্রামে শুক্রবার বিকেলে ইমরান (২৮) নামে এক যুবক বজ্রপাতে মারা গেছে। তিনি ধলাপাড়া গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।

নারায়ণগঞ্জ: সদর উপজেলার ফতুল্লায় বজ্রপাতে বান্টি ওরফে আকাশ নামে ৭ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও তিন শিশু। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টায় রেলস্টেশন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

আহত শিশু শাহজাহান, আসাবুর ও শামীমকে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে শামীমকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

কুলাউড়া মৌলভীবাজার: শুক্রবার বিকেল উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের ছকাপনের শ্রীখণ্ডি বিলে কৃষিকাজ করার সময় বজ্রপাতে মারা যান দিশাই মালাকার।

স্থানীয়রা জানায়, বজ্রপাতে গুরুতর আহত দিশাই মালাকারকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পাবনা: পাবনার সুজানগর ও বেড়া উপজেলায় শুক্রবার বজ্রপাতে আরও চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে তাদের বিস্তারিত নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

Leave a comment