অধিকাংশ স্থানেই ভোট চুরিতে নতুন মাত্রা দিলেন নির্বাচনী কর্তারা

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ভোটের রক্ষক তথা দায়িত্বপ্রাপ্তরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভক্ষকে পরিণত হয়েছেন। নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপিতে জড়িয়ে পড়েছেন খোদ প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা। শুধু নির্বাচনের দিনই নয় ভোটের আগের রাতেই অনেক স্থানে সিল মেরে বাক্স ভরার কাজ সেরে ফেলেছেন তারা। এসব অভিযোগে এখন পর্যন্ত শতাধিক প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারকে আটক করা হয়েছে। কারাদণ্ডও হয়েছে কয়েক জনের। এদের মধ্যে কুমিল্লায় ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ৪ জনকে। আর ৫ জন প্রিসাইডিং অফিসার ও ৭ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে আটক করেছে পুলিশ। শেরপুরে ঘুষ লেনদেনের সময় আটক হয়েছেন একজন প্রিসাইডিং অফিসার। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ৭ দিনের কারাদণ্ড দিয়েছে। এত কিছুর পরেও বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন তারা। প্রিসাইডিং অফিসারদের এই বেপরোয়া আচরণের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক স্থানেই দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদেরকে নির্বাচনী দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, ভোট অনিয়মে প্রিসাইডিং অফিসারদের জড়িয়ে পড়া অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। নোংরা মানসিকতাসম্পন্ন ঘৃণিত ব্যক্তিরাই এ ধরনের কাজ করতে পারেন। তবে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা অনিয়মে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন। ইতোমধ্যে বেশকয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কলেজের শিক্ষক, ব্যাংকারসহ সরকারি-আধা সরকারি-স্বায়ত্ত্বসাশিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রিসাইডিং অফিসার করা হয়। ভোটকেন্দ্রের রক্ষক বা অভিভাবকের দায়িত্বে থাকেন তারা। তারা ভক্ষক হলে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আইনেই ভোট চালু ও বন্ধের সব ক্ষমতা রয়েছে প্রিসাইডিং অফিসারের। অথচ প্রিসাইডিং অফিসাররা অনিয়মে কেন্দ্র বন্ধ না করে বরং নিজেরাই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল সমর্থকদের প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কারণে অনেক বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তারা। মেহেরপুরের গাংনীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতাকে প্রিসাইডিং অফিসার করা হয়। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় দলের নেতাদেরও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ফলে ভোটে সরাসরি অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। শনিবারের চতুর্থধাপের ভোট চলাকালে অনিয়মে জড়িয়েছেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা। ভোটের আগের রাতে সিল মারা ব্যালট বাক্সে ভরা, দায়িত্বে অবহেলা, ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন কারণে কুমিল্লা, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গাসহ কয়েকটি জেলায় অন্তত অর্ধশতাধিক প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং-পোলিং কর্মকর্তাদের আটক করে পুলিশ। এদের মধ্যে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে চারজনকে। ব্যালটে সিলমারা ও জাল ভোট প্রদানে সহযোগিতার অভিযোগে কুমিল্লার তিন উপজেলায় পাঁচজন প্রিসাইডিং অফিসার ও সাতজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে আটক করে পুলিশ। ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিলমারার কারণে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মুন্সীরহাট ইউনিয়নের যুগীরহাট এতিমখানা ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ও একই উপজেলার শলাকান্দি জেসি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোবারক হোসেন এবং একই কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার তাজুল ইসলামকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মনোহরগঞ্জ উপজেলার মৈশাতুয়া ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকে সিল মারার অভিযোগে হাবিবুর রহমান নামের একজন প্রিসাইডিং অফিসারকে আটক করেছে পুলিশ। ব্রাহ্মণপাড়ার মাধবপুর ইউনিয়নের চান্দলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট আটজনকে আটক করা হয়। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভবানীপুর ইউপির ভবানীপুর মাদ্রাসা ও স্কুলকেন্দ্র দখল করে প্রিসাইডিং অফিসার আবুল কাসেম, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার শহীদুল্লাহ খান, সলেমান মিয়াসহ তিনজন পোলিং অফিসারকে সিলমারা ঘটনায় আটক করা হয়। এ ছাড়াও ওই কেন্দ্র থেকে ১২ জন পোলিং এজেন্টকেও আটক করে পুলিশ। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের দুটি কেন্দ্রে শুক্রবার রাতে ব্যালটে নৌকা প্রতীকে সিল মারার ঘটনায় নজরুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয় ও আচ্চাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের দুই প্রিসাইডিং অফিসারকে আটক করে পুলিশ। তারা হলেন আনিছুজ্জামান ও আক্রামুজ্জামান।

ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে শুক্রবার রাতে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতিবান্ধা ইউনিয়নের লয়খা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আব্দুল বারিক মিয়াকে সাত দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অনিয়মের কারণে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার হারদি ইউনিয়নের শেখপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবিএম মমিনুর রশীদকে প্রত্যাহার করা হয়। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে ছয় পোলিং এজেন্টকে আটক করে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। মেহেরপুরের গাংনীতে এক পোলিং এজেন্টকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

তৃতীয় ধাপেও অনিয়মে কর্মকর্তারা: গত ২৩ এপ্রিল তৃতীয় ধাপেও ইউপি নির্বাচনেও প্রকাশ্য ভোট অনিয়ম জড়িয়ে পড়েছিলেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। নৌকা প্রতীকের ব্যালটে সিল মারার কারণে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউপির ঠাকুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আবদুর সবুর খানকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। তিনি সেন ভাঙ্গবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার জগতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে একজন প্রার্থীর পক্ষে সিল মারার অভিযোগে রফিজুল আলম, শাহ আলম নামের দুই সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে আটক করা হয়। এরা দুইজনই ওই উপজেলার শ্রীমন্তপুর এমএ সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওই দুই শিক্ষককে ভোটের দিন রাতে দুই মাসের জন্য বরখাস্ত করার নির্দেশ দেয় ইসি। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার রাজগাতী ইউপির কান্দাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের ব্যালটে সিল মারার সময় হাতেনাতে ওই কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার নজরুল ইসলামকে আটক করে পুলিশ। এ ছাড়াও কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী ইউপির নয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের ব্যালটে গরমিল থাকায় ওই কেন্দ্রের এবং জাল ভোট দিতে সহযোগিতা করায় বগুড়ার ধুনট উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের এলাঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারকে প্রত্যাহার করে কমিশন।

দ্বিতীয় ধাপে আটক করা তিনজনকে গত ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ইউপিতে ব্যালটে সিলমারার অভিযোগে যশোর সদর উপজেলায় তিনজন নির্বাচনী কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছিল। সিল মারা ব্যালট পেপার জিম্মায় রাখার অভিযোগে যশোরের চুড়ামনকাঠি ইউপির বিজয়নগর সরকারি প্রাথমিক কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার রফিকুল ইসলাম ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ইসরাত জাহান এবং চুড়ামনকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার মোহাম্মদ বিন আকবরকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।