সিঙ্গাপুরে ফের আট বাংলাদেশি : ছক ছিলো দেশে ফিরে সরকার উত্খাতের!

 

স্টাফ রিপোর্টার: মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে আবারো জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে সিঙ্গাপুরে উগ্রপন্থী ৮ বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, তারা বাংলাদেশি ‘ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ’ (আইএসবি) নামের একটি গোপন সংগঠনের সদস্য। দেশে ফিরে তারা নির্বাচিত সরকারকে সশস্ত্র পন্থায় উত্খাত করে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলো। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের সমর্থক এই ‘জঙ্গিদের’ কাছ থেকে একটি হিটলিস্ট উদ্ধার করা হয়েছে। হিটলিস্টে রয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ, র্যাব, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবির কর্মকর্তা, মন্ত্রী, এমপি, সাংবাদিক, অবিশ্বাসী। অস্ত্র ব্যবহার ও বোমা তৈরির পদ্ধতি সংক্রান্ত দলিলপত্র এবং উগ্রপন্থী বইপত্রও পাওয়া গেছে তাদের কাছে। সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষ বলছে, এই আট বাংলাদেশি জঙ্গিকে গত এপ্রিলে আটক করা হয়েছে। এদিকে, একই অভিযোগে সিঙ্গাপুরে আটকের পর ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো পাঁচ জনকে গতকাল মঙ্গলবার অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বনশ্রী এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মিজানুর রহমান ওরফে গালিব হাসান, মো. রাহা মিয়া পাইলট, মো. আলমগীর, তানজিমুল ইসলাম ও সন্টু খান নামের ওই পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। এ সময় তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদ নিয়ে লেখা কিছু বই ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত জানুয়ারিতে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে সিঙ্গাপুরে আটক ২৭ বাংলাদেশির ২৬ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছিলো। এদের মধ্যে ১৪ জনকে আটক করা হয়েছিলো। বাকি ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তেমন কোন তথ্য না পাওয়ায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে তাদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আট বাংলাদেশি জঙ্গিকে আটকের কথা বলা হয়। তারা সবাই স্থানীয় বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থাসহ নানা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো। আটককৃতরা হল শরিফুল ইসলাম (২৭), লিয়াকত আলী মামুন (২৯), মো. জাবাথ কায়সার হাজী নুরুল ইসলাম সওদাগর (৩০), রুবেল মিয়া (২৬), মিজানুর রহমান (৩১), সোহাগ ইব্রাহিম (২৭), সোহেল হাওলাদার ইসমাইল হাওলাদার (২৯) ও দৌলত জামান (৩৪)। এদের মধ্যে মিজানুর রহমান চলতি বছরের মার্চ মাসে ‘আইএসবি’ প্রতিষ্ঠা করে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, আইএসবির এই সদস্যরা বিদেশি যোদ্ধা হিসেবে আইসিসে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলো। কিন্তু সিরিয়ায় যাওয়া কঠিন হবে বলে তারা পরিকল্পনা করে যে তারা বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে নির্বাচিত সরকারকে সশস্ত্র পন্থায় উত্খাত করবে। বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করে আইসিসের খেলাফতের অধীনে নেয়ার পরিকল্পনা ছিলো তাদের। বাংলাদেশে এই গোষ্ঠীটির অন্তত দুই জন সদস্য আছে বলে জানানো হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দেখা গেছে, আইএসবি’র সদস্য বাংলাদেশে কিছু লক্ষ্যবস্তুতে হামলার পরিকল্পনা করেছিলো। ‘আমাদের জিহাদ করা প্রয়োজন’ নামে লেখা পুস্তিকাসহ তাদের কাছ থেকে কিছু নথি-পত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে তারা সিঙ্গাপুরে সদস্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে। সংগঠনকে বড় করতে তারা সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের দলে টানার চেষ্টা করছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে তারা সিঙ্গাপুরে কমর্রত বাংলাদেশিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছিল। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে অর্থও জব্দ করা হয়েছে।

 

সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ বলছে, আইএসের প্রতি এসব আইএসবি’র সদস্যদের সমর্থন থাকায় তারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তারা বিদেশেও সহিংসতা চালানোর জন্য প্রস্তুত ছিলো। মিজানুর রহমান স্বীকার করেছে, আইএসের নির্দেশমতো সে যেকোনো দেশে হামলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল। তবে সিঙ্গাপুরে হামলা করার নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনার কথা কর্তৃপক্ষ জানাতে পারেনি। আটকদের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। কয়েকজনের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগে মামলা করা হতে পারে বলে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

হিটলিস্টে যারা: প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইএসবির মূল হোতা মিজানুর রহমানের কাছ থেকে বাংলাদেশে হামলার একটি হিটলিস্ট পাওয়া গেছে। এই হিটলিস্টে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব), পুলিশ, সিভিল ইনফরমেশন ডিফেন্স (সিআইডি), বিমান বাহিনী, নৌবাহিনীর কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, গণমাধ্যম কর্মী, অবিশ্বাসী (হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নাস্তিক, মুনাফিক)। তার কাছ থেকে অস্ত্র ব্যবহার ও বোমা তৈরির পদ্ধতি সংক্রান্ত দলিলপত্র এবং উগ্রপন্থী বইপত্র পাওয়া গেছে।

ফেরত পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ: উন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার  মনিরুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সিঙ্গাপুরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই দেশে অবস্থানরত ১৩ বাংলাদেশিকে আটক করে। তাদের প্রাথমিক  জিজ্ঞাসাবাদের পর ৫ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় এবং বাকি ৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদরে জন্য সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের হেফাজতে রেখেছে। যে ৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদেরকে আটক করা হয়েছে। তিনি বলেন, গত ২৯ এপ্রিল তাদের ফেরত পাঠানো হয়। তখন থেকেই আমরা তাদের নজরদারিতে রাখি। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদ সম্বলিত বেশ কিছু  বই ও পার্সপোট উদ্ধার করা হয়। অতিরিক্ত কমিশনার আরো বলেন, সিঙ্গাপুর র্কতৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, আটকরা ওই দেশে অবস্থান করে জঙ্গিবাদে যোগদানের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছিল। তারা জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থও সংগ্রহ করছিল। তিনি আরো বলেন, তাদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরের  অভিযোগ সম্পর্কে আমরা যাচাই বাছাই করছি। দেশের কোন জঙ্গি সংগঠনকে তারা আর্থিক সহায়তা করত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয় আমরা এখনো জানতে পারিনি। তবে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর জানাতে পারবো। তিনি জানান, মামলা করার পর আজ বুধবার আদালতে পাঠিয়ে  আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।

জঙ্গিবাদ দমনে দুই দেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে: সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে আটক বাংলাদেশিদের বিষয়ে জানতে চাইলে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মাহবুব উজ জামান গতকাল বিকেলে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ আটককৃত আট বাংলাদেশিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের নিরাপত্তা সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। আগে থেকেই তথ্যের আদান-প্রদান ও সহযোগিতা রয়েছে। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ দমনে দুই দেশের অভিন্ন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, এর আগে সন্দেহভাজন ২৭ বাংলাদেশি জঙ্গিকে আটক করেছিল সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। এবারের ১৩ জনকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে এ পর্যন্ত মোট ৪০ জন সন্দেহভাজন বাংলাদেশি জঙ্গিকে আটক করা হয়েছে।