কেএ মান্নান: আলমডাঙ্গার ঘোষবিলায় কুমারনদের তীরে ঐতিহাসিক কুবীর ঠাকুরের গঙ্গাস্থানে বর্ণাঢ্য চৈতি বারুনী মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল সোমবার ভোর হতেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজারো নারী-পুরুষের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে। শিশু-যুবা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পুণ্যার্থীদের উপস্থিতিতে কুমারনদের তীরবর্তী এই পুণ্যস্থানের গঙ্গাস্থান নামক স্থান হয়ে ওঠে উৎসবমুখর ও সরগরম। বাৎসরিক এ দিনটি এলাকার মানুষের কাছে এক রকম আনন্দের হয়ে ওঠে। মিষ্টি কেনা মিষ্টি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। রোগ-শোক আর বিপদগ্রস্ত মানুষ রোগমুক্তি শেষে কামনা করে গঙ্গাস্থানে ছুটে আসে তাদের বিশ্বাসের দায়মুক্তি হতে। এ বিশ্বাসে মানুষের কতোটা রোগমুক্তি কিংবা বিপদমুক্তি হয় সে ব্যাপারে এর যুক্তি হলো ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহু দূর’। কথিত আছে ইংরেজি ১৮৮৭ বঙ্গাব্দ ১১৯৪ সালে আলমডাঙ্গা থানার জামজামি ইউনিয়নের ঘোষবিলা রঘুনাথপুর গ্রামে কুবীর ঠাকুরের জন্ম হয়। পিতা ছিলেন মুসলমান মাতা যোগিনী সাধিকা। আকস্মিক কুবীরের পিতা গর্ভবতী স্ত্রীকে ছেড়ে হন নিরুদ্দেশ। গর্ভের সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন যোগিনী সাধিকা। যথাসময়ে ভুমিষ্ঠ হয় এক ফুটফুটে পুত্রশিশু। মা নাম দেন কুবীর। এলাকাবাসী কুবীরকে বাপ পরিচয়হীন জারজ বলে আখ্যায়িত করলে মাতা যোগিনী কুবীরকে কোলে নিয়েই পার্শ্ববর্তী মধুপুর গ্রামে আশ্রয় নেন। শিশুকাল থেকেই কুবীর ছিলেন উদাসীন ও ধার্মিক। গুরুর কাছে দীক্ষা নেয়ার আশায় মাতা যোগিনী তাকে প্রেরণ করলে গুরু তাকে শিষ্য বানাতে চাননি এই ভেবে
যে সে পিতৃ পরিচয়হীন। পিছু ছাড়তে নারাজ কুবীর। বাধ্য হয়ে গুরু শেষ পর্যন্ত শিষ্য করে নেন কুবীরকে। এ সময় কবীবের নাম দেন কুবীর ঠাকুর বা কুবীর গোসাই। জনশ্রুতি আছে একদিন কুবীরের মাতা গঙ্গাস্নানে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করলে কুবীর তা খেয়ালবশত আমলে না নিয়ে কর্মে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। মা এতে কুবীরের ওপর অসন্তুষ্ট হন। পরের বছর মা পুনরায় গঙ্গাস্নানের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এতে কুবীর সম্মতি দেন নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সেই বেখেয়াল আনমনা কুবীর। একাধারে তাঁত চালায় আর মনে মনে গাঁন গায়। এতে মায়ের রাগ হয় ছেলে কুবীবের ওপর। সকলেই যাত্রা করেছে গঙ্গাস্নানের পুণ্যার্থী হয়ে। মা যোগিনী মনে খুব কষ্ট পান। হঠাৎ কুবীর মাকে বলে ওঠে মা তৈরি হও গঙ্গাস্নানে যাবো। মা যোগিনীতো অবাক ! এ কী! গঙ্গা কি এখানে যে বললেই চলে যাওয়া যাই? কুবীর মাকে নিয়ে ঘোষবিলার কুমার নদের তীরে এসে দাঁড়ায়।
কুবীর এবার বলে ‘মা তোমাকে দেখতে চান, গঙ্গা তুমি দর্শন দাও।’ কথা মতোই কাজ। স্বরূপে গঙ্গা আবির্ভূত হলে কুবীর মাকে বলে যাও স্নান করো। মা যোগিনী স্নানে নেমে ডুব দিয়ে উঠতেই যুবতী হয়ে ওঠেন। বিপত্তি বাধে, যখন মা-ছেলে বাড়ি ফেরে। পথে হইচই ও কানাঘোষা শুরু হয়ে যায়। অভিযোগ ওঠে কুবীর তার বৃদ্ধা মাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে অন্য যুবতীকে ভাগিয়ে এনেছে। কুবীর গ্রামবাসীকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে মাকে সাথে নিয়ে পুনরায় ওই কুমারনদের পাড়ে আসে। আবার মাকে কুমারের জলে ডুব দিতে বলে। মা যোগিনী জলে নেমে ডুব দেয়। নেয়ে উঠে সেই আগের মতো বৃদ্ধা হয়ে যান। লোকমুখে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। উৎসুক ও কৌতূহলী নারী-পুরুষের ভিড় জমে যায় সেখানে। এ থেকেই কুমারনদকে গঙ্গা ভেবেই দরিদ্র পুণ্যার্থীরা গঙ্গাস্থান বলে বিশ্বাস করে থাকে। সেই থেকেই এখানে হয়ে আসছে গঙ্গাস্থানের বার্ষিক দুটি ঐতিহাসিক মেলা। রোগশোক থেকে মুক্ত হতে দূর দূরান্তের হাজারো পুণ্যার্থীদের আগমন ঘটে এখানে। মানত শোধ দিয়ে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়।