মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই আর সনদ নিয়ে বাণিজ্য!

 

মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই শ্রদ্ধাবোধ ফুটে ওঠে। অথচ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যখন মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মাঝেমাঝেই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। মহান স্বাধীনতার এতোদিন পরও যখন দফায় দফায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় যিনি ছিলেন শিশু তিনিও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলে সনদ নিয়ে দিব্যি নেতা হয়ে বসেছেন। এতে শ্রদ্ধাবোধে কিছুটা হলেও ঘুন ধরে। প্রশ্ন ওঠে, আর কতোদিন চলবে যাচাই বাছাই, কতোদিন থাকবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা?

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করেছে। অভিযোগ আছে, সেসব তালিকায় অনেক রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তি পেয়েছে, আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিলো। তখনই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হতে থাকে। সচিব থেকে শুরু করে অনেকেরই নাম চলে আসে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। সঙ্গত কারণেই সেই তোড়জোড়ে একসময় ভাটা পড়ে। বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা লুটেপুটে খাচ্ছে। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত হয়ে ফিরে আসার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি অপমানিত মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কেন এমন হবে? অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধ করেছেন। সেখানে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে নির্ধারিত ফরম পূরণ করতে হয়েছে। এর ভিত্তিতে তৈরি করা তালিকা ভারত বাংলাদেশকে দিয়েছে। অন্তত এ তালিকার কেউ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার কথা নয়, অথচ তা-ও হয়েছে। স্বাধীনতার পর ঢাকা সেনানিবাস থেকে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের রেজিস্ট্রারে সই নিয়ে এককালীন কিছু অর্থ দেয়া হয়েছিলো। শুদ্ধ তালিকা করতে চাইলে সেই রেজিস্ট্রারের সহায়তা নেয়া যেতো। বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়েছিলেন, তাদের সঠিক সংখ্যা ও তালিকা তৈরি করাও কঠিন হতো না। কিন্তু সেই পথে কখনো কোনো সরকার এগোয়নি। এর বদলে বরাবরই দলীয়ভাবে তালিকা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। আর সে কারণেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ছিটকে পড়েছেন, তালিকায় ভুয়াদের সংখ্যা বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াত-শিবিরও তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ করতে পারে। ভিন্নমতের কোনো মুক্তিযোদ্ধা সেখানে গেলে তাকে বের করে দেয়ার সাহস দেখাতে পারে। হায়, মুক্তিযোদ্ধার সম্মান!

নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না, স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে চার দশকে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় রূপ দিতে গিয়ে ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন সরকার মানুষের সেই শ্রদ্ধাবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতাসহ কিছু সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। একই সাথে অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংশোধন এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়বাড়ন্তের যেসব খবর পত্র-পত্রিকায় আসছে, তা সচেতন সমাজকে আহত করে। হৃদয়ে বাড়ে রক্তক্ষরণ।