খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা
স্টাফ রিপোর্টার: আদালত অবমাননার দায়ে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। অনাদায়ে সাত দিনের কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে জরিমানার টাকা ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও লিভার ফাউন্ডেশনে জমা দিতে আদেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে ক্ষমতাসীন কোনো মন্ত্রীকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে এ ধরনের দণ্ড দেয়া হয়নি। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের আট বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আদালত গতকাল রোববার এই আদেশ দেন।
আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশে শুধু দণ্ডাদেশের অংশটুকু ঘোষণা করা হয়েছে। মন্ত্রীদের আদালত অবমাননা, সংবিধান লঙ্ঘন এবং শপথ ভঙ্গ, বিচার কাজে হস্তক্ষেপ, বিচারাধীন বিষয়ে বক্তব্য দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা থাকবে বলে আইনজীবীরা আশা প্রকাশ করেছেন। তবে এ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছে, দুই মন্ত্রী নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে এবং অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে যে আবেদন করেছেন তা আমরা গ্রহণ করলাম না। আবেদনকারীরা মন্ত্রী, সাংবিধানিক পদধারী। তারা সংবিধান রক্ষার শপথবদ্ধ। তারা প্রধান বিচারপতি ও সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননা করে তারা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমাদের কাছে উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হয়েছে। তাদের বক্তব্য বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল এবং বিচার বিভাগের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। যদি তাদের ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে যেকোনো ব্যক্তি বিচার বিভাগ সম্পর্কে একই রকম অবমাননাকর বক্তব্য দেবেন। এ জন্য তাদের আমরা গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করছি। তবে তারা প্রথম সুযোগেই নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ায় শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে আদালত উদারতা দেখাচ্ছে।
গতকাল রোববার সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের আট বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের শুনানি হয়। সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে আইনজীবীদের সাথে দুই মন্ত্রী আপিল বিভাগে হাজির হন। ৯টা ২৮ মিনিটে আদালত অবমাননার দাখিলকৃত জবাবের শুনানি শুরু হয়। শুরুতেই মন্ত্রী কামরুলের পক্ষে অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, আদালত অবমাননাকারীরা হাজির হয়েছেন। এ সময় তার পেছনে দাড়ানো ছিলেন দুই মন্ত্রী। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বসতে বললে তারা বসে পড়েন।
বাসেত মজুমদার বলেন, আদালত অবমাননকারী কামরুল ইসলাম নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন দাখিল করেছেন। একইসাথে ভবিষ্যতে এ ধরনের উক্তি করা থেকে বিরত থাকবেন বলেও অঙ্গীকার করেছেন। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের প্রতি তার শ্রদ্ধা রয়েছে। ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন গ্রহণ করে আদালত অবমাননার ফৌজদারি ও দেওয়ানি দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করছি।
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, বিলিয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনাসভা নিয়ে জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়েছেন? অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, পড়া হয়নি। তখন বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা পত্রিকার ক্লিপিং বেঞ্চ কর্মকর্তার মাধ্যমে অ্যাটর্নি জেনারেলকে দেন। অ্যাটর্নি জেনারেল প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান। প্রতিবেদন থেকে দুই মন্ত্রী ছাড়াও আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী, জনকণ্ঠ সাংবাদিক স্বদেশ রায়, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্যও পড়ে শোনানো হয়। প্রতিবেদন পড়া শেষ হলে অবমাননাকারী মন্ত্রীদের আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা তো জানেন স্বদেশ রায় একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীও ৪-৫ বছর ধরে রায় দিচ্ছেন না। যার কারণে তার বেতন আটকে রাখা হয়েছিলো। আমার বক্তব্য রেকর্ড করেও তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন ওই ব্যক্তি। এই দুজন বিতর্কিত ব্যক্তির সাথে একমঞ্চে কেন সাংবিধানিক পদধারী দুজন মন্ত্রী বক্তব্য দিতে গেলেন?
প্রধান বিচারপতি বলেন, স্বাধীনতার পর যারা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে থেকে ব্যারিস্টার আমিনুল হক, অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মন্ত্রীদের বক্তব্যে বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকেও কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা হয়েছে। এ পর্যায়ে মন্ত্রী মোজাম্মেলের আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, আমি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাকে ক্ষমা করুন।
অ্যাডভোকেট বাসেত বলেন, জনকণ্ঠের ওই প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ হয়নি। বক্তব্যের জন্য মন্ত্রী দুঃখিত। বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা বলেন, মন্ত্রীরা যেসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন তা জনগণের জানা দরকার। এজন্যই জনকণ্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদনটি পড়ে শোনানোর জন্য বলা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের কর্তৃত্ব ও মর্যাদা বজায় রাখা হয় বলেই বুড়িগঙ্গার অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। আমরা যখন বিচার করি তখন মাথানত করি না এবং করবোও না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যেতে চাই। এরপরই প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা ১০ মিনিটের জন্য বিরতিতে যাচ্ছি। এরপরই আদেশ দেবো। পরে ১০টা ২০ মিনিটে পুনরায় এজলাসে আসেন বিচারপতিগণ।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা উচ্চ আদালতের বিচারকরা সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করেছি। জনকণ্ঠের রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ইচ্ছেকৃতভাবে আমরা কোনো প্রসিডিং ড্র করিনি। একটাই কারণ প্রকৃতপক্ষে আমরা আদালত অবমাননা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাই না। এটা হলে আমরা বিচার প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবো না। সারা জাতিকে একটি মেসেজ (বার্তা) দেয়ার জন্যই শুধু দুইজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমানার অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে যদি কেউ এ ধরনের অবমাননার ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন তাহলে তারা দেখবে আমরা কতো কঠোর হতে পারি।
এরপরই সংক্ষিপ্ত আদেশের অংশ পাঠ শুরু করেন প্রধান বিচারপতি। আদেশে ঘোষণার এক পর্যায়ে অ্যাডভোকেট বাসেত বলেন, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন যেহেতু গ্রহণ হয়নি সেহেতু আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো। প্রধান বিচারপতি আদেশ ঘোষণা থামিয়ে দিয়ে বলেন, ঠিক আছে আমরা এখন বিরতিতে যাবো। এসে আদেশ দেবো। তখন খাদ্যমন্ত্রীর আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুবের মাধ্যমে বাসেত মজুমদারকে এ বিষয়ে অগ্রসর হতে নিষেধ করেন। সাথে সাথে অ্যাডভোকেট বাসেত বলেন, আমি দুঃখিত। আমার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। পরে আদেশের বাকি অংশ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। আদেশ ঘোষণার পর দুই মন্ত্রী নীরবে আইনজীবীদের সাথে করে আদালত ত্যাগ করেন।