মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুর জেলায় এবার গমবীজ উৎপাদন হচ্ছে না। ব্লাস্ট নামক ভয়ঙ্কর ছত্রাকের আক্রমণে বীজ উৎপাদন করতে পারেনি জেলায় অবস্থিত দুটি বীজ উৎপাদন খামার। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বিএডিসি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, পুলিশ প্রশাসন ও খামার কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বারাদী ও চিৎলা খামারে আবাদকৃত গমবীজ ক্ষেত আগুনে পোড়ানো হয়। অন্যদিকে ব্লাস্টের আক্রমণে ব্যাপক ফলন বিপর্যয়ের মুখে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন গমচাষিরা। ফলে গম পরবর্তী পাটচাষে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। আগামী মরসুমেও জেলার গম আবাদে কী পরিণতি হবে তা নিয়েও চাষিদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
চলতি বছর জেলায় ১৩ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে উচ্চফলনশীল বারী জাতের গম আবাদ করা হয়।
এর মধ্যে কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদন প্রদর্শনী প্লট থেকে বীজ উৎপাদনের প্রস্তুতি ছিলো। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) উদ্যোগে চিৎলা পাটবীজ খামারে ১৫০ একর এবং বারাদী বীজ উৎপাদন খামারে ১২৮ একর জমিতে বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে গম আবাদ করা হয়। দুটি খামার থেকে প্রায় ৫শ মেট্রিক টন গমবীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ব্লাস্ট ছত্রাকের আক্রমণে এসব প্লট বা খামার থেকে চলতি মরসুমে বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। আগামী বছরে গমচাষ ও চলতি মরসুমে বোরো ধানে ব্লাস্ট ছত্রাক ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় গতকাল শুক্রবার দুপুরে চিৎলা ও বারাদী খামারে আবাদকৃত সমস্ত গমক্ষেত পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে জেলার গম বীজের চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখা এ দুটি খামার থেকে চলতি মরসুমে কোনো বীজ উৎপাদন হচ্ছে না। খাওয়ার উপযোগী গম সংরক্ষণ করলে তা থেকে ব্লাস্ট ছড়াতে পারে বিধায় কর্তনের আগেই ক্ষেত থেকে গম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানালেন চিৎলা পাট বীজ খামারের যুগ্মপরিচালক আবির হোসেন। তবে খামার পর্যায়ে আক্রান্ত ক্ষেত পোড়ানো হলেও কোনো চাষি তাদের ক্ষেতের গম পোড়াননি।শুধু গমবীজ উৎপাদনেই নয়, ফলন বিপর্যয়ে পড়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন জেলার হাজার হাজার গমচাষি।
বাঁশবাড়ীয়া গ্রামের গমচাষি পারভেজ হোসেন ও মুছাদ আলী জানান, গত বছর বিঘাপ্রতি ১৮-২০ মণ গম উৎপাদন হয়েছিলো। এবার ব্লাস্টের আক্রমণে বেশিরভাগ ক্ষেতে ১০ কেজি থেকে ১ মণ ফলন হয়েছে। এতে লাভ তো দূরে থাক চাষের খরচই উঠছে না। ফলন বিপর্যয়ে পড়ে জেলার গমচাষিরা ঋণগ্রস্ত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। গম পরবর্তী পাটচাষের অর্থ জোগাড় করতে নতুন করে ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছেন কৃষকরা। অন্যদিকে নিজস্ব গম বীজের উৎস হারানো এবং ব্লাস্ট প্রতিরোধে কোনো কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনো উদ্ভাবন না হওয়ায় আগামী বছর গম আবাদ দিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন গম চাষিরা।
গত মাসের শেষের দিকে ব্লাস্ট সন্দেহে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের দিনাজপুর গম গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পরিতোষ কুমার মালাকারের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিকদের একটি দল জেলার বিভিন্ন মাঠের গমক্ষেত পরিদর্শন করে। গমের ব্লাস্ট নামক ছত্রাকের আক্রমণ নিশ্চিত করে তিনি আক্রান্ত ক্ষেতে নাটিভো ও ফলিকর নামের ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেন। তবে আক্রান্ত ক্ষেতে ওই ছত্রাকনাশক দিয়েও প্রতিকার হয়নি। দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে ব্লাস্ট মহামারী আকার ধারণ করেছে বলে অভিযোগ চাষিদের।
এ প্রসঙ্গে পরিতোষ কুমার মালাকার বলেন, দেশে গমে ব্লাস্ট আক্রান্তের ঘটনা এই প্রথম। তাই এর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণাগারের ল্যাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে ব্লাস্ট কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা ঠিক করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত এর প্রতিকার কিংবা প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কোনো পরামর্শ দিতে পারেননি গম গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা।
ধানখোলা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক জানান, রবি মরসুমের গম, মসুর, ছোলা, ভুট্টা, পেঁয়াজ রসুন জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে চাষাবাদ হয়ে থাকে। ধানসহ বিভিন্ন ফসলের লোকসান পুষিয়ে যায় রবি ফসলে। কিন্তু চলতি মরসুমে গমসহ রবি ফসলের ফলন বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত চাষিরা। তাই সরকারি সহযোগিতা না পেলে চাষিদের ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব হবে।
এদিকে জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা ডক্টর আখতারুজ্জামান জেলার গমক্ষেত থেকে গমবীজ সংগ্রহ না করার জন্য সকলের প্রতি সতর্ক করেছেন। তিনি জানান, কাউকে বীজ প্রত্যয়ন দেয়া হবে না। চাষিদের যারা গম কর্তন করছেন তাদেরও কিছু করণীয় রয়েছে। গমের শীষের দিকে কেটে নিয়ে গোড়ার অংশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে হবে। বোরো ধানের দিকেও সতর্ক নজর রাখতে হবে। গম ও ধান একই গোত্রীয় ফসল হওয়ায় গমের ব্লাস্ট বোরো ধানে আক্রান্ত হতে পারে। চলতি মরসুমে গম আবাদের ক্ষেতে এ বছর ধান আবাদ করা যাবে না এবং আগামী মরসুমে এসব জমিতে গম আবাদ না করার প্রতি জোর দিলেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) জিএম নূর মহাম্মদ মণ্ডল চিৎলা পাটবীজ খামারে গমক্ষেত পোড়ানো কার্যক্রমের নেতৃত্বে ছিলেন। ব্লাস্ট আক্রান্ত গমক্ষেত থেকে কোনো অবস্থায় বীজ রাখা যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, মেহেরপুর জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলা ছাড়া দেশের অন্য কোথাও ব্লাস্ট আক্রমণ দেখা দেয়নি। তাই অন্য জেলায় উৎপাদিত বীজ দিয়ে আগামী বছর আবারো এ অঞ্চলে গম আবাদের আশা প্রকাশ করেন তিনি।