আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি : যেখানে থমকে আছে ৭১

রহমান মুকুল: বধ্যভূমির স্মৃতি মনে হলেই বুকের ভেতর খুব করে হাহাকার তোলা বিভীষিকাময় কাঁপন অনুভব করি। বধ্যভূমির নাম শুনলেই কানে বাজে নাম না জানা অসংখ্য মর্মান্তিক নিহত স্বজনের অস্তিত্বের সুতীব্র যন্ত্রণার আহাজারি। কুমারী বোনের বুকফাটা গগণবিদারি আর্তনাদ। সহস্র যন্ত্রণায় শহীদ মা-বোনের নীল কাতরানি। বর্বরতম এ হত্যাকাণ্ডের বেদনামথিত ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে এখানে। এখানে মুক্তির আনন্দকে ছাপিয়ে যায় কান্নার রোল। ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে ছুটে গিয়ে যিনি খোদ আলমডাঙ্গা থানায় উড্ডীন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে অমিত সাহসে অগ্নি সংযোগ করেছিলেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমডাঙ্গা কালিদাসপুরের মঈন উদ্দীন আহমেদের সাথে কথা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার সময় তিনি বধ্যভূমি সম্পর্কে বলেন, আলমডাঙ্গায় রেললাইনের কুমার নদের ওপর অবস্থিত লালব্রিজের দু পাশে ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। রেললাইনের ডাউনে অর্থাৎ লালব্রিজের আলমডাঙ্গার পাশে ১টি ও নদের অপর পাড়া অর্থাৎ কালিদাসপুরে আরেকটি মিলিশিয়া ক্যাম্প ছিলো। আপের দিকে গমণকারী ট্রেন লালব্রিজের আলমডাঙ্গা মাথায় দাঁড় করাতো। অন্যদিকে, ডাউন ট্রেন লালব্রিজের কালিদাসপুর প্রান্তে দাঁড় করিয়ে নিরপরাধ যাত্রীদের ধরে নিয়ে যেতো। অকথ্য নির্যাতন শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ এ বধ্যভূমিতে ফেলে রাখতো।

প্রথমদিকে, এ সকল মিলিশিয়ারা খুঁজে খুঁজে ট্রেন থেকে হিন্দু ধর্ম্বালম্বীদের আটক করতো। সন্দেহভাজন ট্রেন যাত্রীকে তার কালেমা কিংবা কোরআনের কোনো সুরা জিজ্ঞেস করতো। বলতে না পারলেই বিভীষিকাময় নির্যাতন শেষে হত্যা। কাউকে কাউকে আবার বিবস্ত্র করে দেখতো হিন্দু নাকি মুসলমান। সিঁথিতে সিদুর দেখতে পেলে তো কোনো কথাই ছিলো না। সরাসরি সে মহিলাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখতো বধ্যভূমির সামনে জিকে প্রকল্পের টার্সিয়ারি খালের পাশের ওয়াপদা করে। বেশ কয়েকদিন ধরে উপুর্যপরি ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। পরে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে হিন্দু-মুসলমান সমানভাবে প্রাণঘাতি এ নির্মমতার শিকার হয়।

কালিদাসপুরের বেশ কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে কথা হয়। তারা বলেন, আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি বরাবর কুমার নদের অপরপাড়ে কালিদাসপুর মাঠের মধ্যেও শ শ নারী-পুরুষকে ট্রেন থেকে নামিয়ে মিলিশিয়ারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালিদাসপুরের জনৈক বয়স্ক ব্যক্তি স্বীকার করেন নির্মম ঘটনার তিনি সাক্ষী! তিনি মাটি খুঁড়ে এখানেই একই গর্তে ৩/৪ জনকে পুঁতে রেখেছিলেন। তিনি একাই বহু নারী-পুরুষের লাশ মাটিতে পুঁতে রেখেছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি তখন সদ্য যুবক। বুকে ভালো করে লোম গজায়নি। তার ঈষৎ লোমশ বুকে রাইফেলের বেয়োনেট ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে এ নির্মম কাজ করিয়ে নিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘদিন পার হলেও এখানে আত্মদানকারী শহীদ বীরাঙ্গনা কিংবা পুরুষদের কোনো স্মারক নির্মিত হয়নি। এমন ভয়ার্ত স্মৃতির সাক্ষ্য স্বরূপ ছড়ানো ছিটানো স্মারকচিহ্নগুলো সময়ের ব্যবধানে এক সময় হারিয়ে যায়। কাল প্রবাহের স্বাভাবিক নিয়মে এ ভয়াল স্মৃতি প্রত্যক্ষদর্শী মানুষের মনেও ফিকে হয়ে আসে। নতুন প্রজন্ম কিংবা দূরান্তের ছিন্নমূল মানুষ যারা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এই এলাকায় পুনর্বাসিত, তারা সম্পূর্ণরূপে এখন সে দুঃসহ বিষাদময় স্মৃতি বিস্মৃত।

গত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে শুরু হয় বধ্যভূমি নির্মাণের প্রাথমিক কাজ। সে সময় জিকে ক্যানেলের ঢালে বসবাসকারী ছিন্নমূল কয়েকজন মানুষ খোঁড়াখুঁড়ি করার সময় লাশের বহু হাড় মাটির নিচ থেকে বের হতে থাকে। বিষয়টি গোপন থাকে না। সকলে ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। বিষয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে মুক্তিযোদ্ধারা দাবি তোলেন এ স্থানটি সংরক্ষণ করে বধ্যভূমি নির্মাণের। মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতি বিধান করে হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুন-এমপি আলমডাঙ্গার বধ্যভূমির স্মারক নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তার আর্থিক বরাদ্ধে সৌকর্যময় শৈল্পিক সুষমায় বধ্যভূমি নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলে। এরই মধ্যে দর্শনার্থীদের ভিড় পরিলক্ষিত হয় এখানে। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষ অব্যক্ত বেদনাতাড়িত হয়ে ছুটে আসেন এখানে। হৃদয়ের অসহ্য দহন জ্বালা, ঘৃণা-ক্রোধ, হিংসা দূর করে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেতে এখানে আসেন অনেকে। অনেকে ছুটে যান বিনোদনের জন্যেও।

এখনো বধ্যভূমির স্মারক নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। এ বধ্যভূমির ডিজাইনার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক আলমডাঙ্গার সন্তান আব্দুস সালাম।

তিনি বলেন, ‘এখনো বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ প্রায় ৪০ ভাগ বাকি রয়েছে। দেয়ালের ওপরের কিছু কাজ, মিউজিয়ামের ভেতরের কিছু কিছু ফিগার, ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির ধারাবাহিক মুক্তিসংগ্রামের সচিত্র ছবির কাজ বাকি। এগুলো করতে প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হবে। এছাড়াও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ছবি, তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের কাজ, মুক্তিযুদ্ধের উন্মুক্ত ভাস্কর্য নির্মাণ করতে হবে। মূলত সমন্বয়হীনতার কারণে অবশিষ্ট কাজ করা এখনও সম্ভব হয়নি। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য হুইপ নিজেও বীর মুক্তিযোদ্ধা। সঙ্গত কারণেই আলমডাঙ্গা বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ সম্পন্নের ক্ষেত্রে তার প্রতি এলাকাবাসীর আস্থা রয়েছে।

ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি মুক্তিযুদ্ধের পর সারাদেশে খুঁজে পাওয়া বধ্যভূমিগুলো (কিলিং ফিল্ড) যাতে নতুন প্রজন্মসহ সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপিত হতে পারে সে ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা গুগল সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এজন্য তৈরি হয়েছে গ্লোবাল পারসেপশন বা জিপিএস ম্যাপ। এলাকাবাসীর দাবি- ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস কমিটির কার্যক্রমের অন্তর্গত করা হোক আলমডাঙ্গার বধ্যভূমিটি। এ ব্যাপারে আশু উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করে সচেতনমহল।

Leave a comment