ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন মেহেরপুরের আশরাফপুরের দুই মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী ও আমিনুল ইসলাম

 

মেহেরপুর অফিস: স্বাধীনতার সুতিকাগার মেহেরপুরের ঐতিহাসিক মুজিবনগর। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ভেদ করে পরাধীনতার বেড়াজাল ভাঙতে বাঙালি ১৯৭১ সালে করেছিলো মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নিঝরা ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীন দেশের লাখো-হাজার যুবক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তির সংগ্রামে। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর সাথে ৯ মাসের যুদ্ধে অংশ নিয়ে কেউ প্রাণ দিয়ে আবার কেউ বুকের রক্ত ঝরিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর আগে। আজকে আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা কেমন আছেন?

মেহেরপুর সদর উপজেলার আমদহ ইউনিয়নের আশরাফপুর গ্রাম। ভৈরব নদ ঘেঁষা এ গ্রামের ১৯ যুবক স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন দেশে বাস করেও ইতোমধ্যে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫ জন। বেঁচে আছেন মুক্তিযুদ্ধের তালিকাভূক্ত আরো ১৪ মুক্তিযোদ্ধা। তাদের মধ্যে শরীরে ক্যান্সার রোগ নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ওই গ্রামের পূর্বপাড়ার ইদ্রিস আলী (৬৮)। আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে পরের জমি লিজ নিয়ে পানচাষ করে ঘুরে দাঁড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম (৬৬)।

মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী জানান, ‘আমার বয়স তখন আনুমানিক বয়স ছিলো ২০ বছর। যুদ্ধে যাওয়ার উপযুক্ত বয়স ছিলো। আর তখনকার দিনে রেডিও-তে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। মেহেরপুরের তদানীন্তন মহাকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সক্রিয় সহযোগিতায় এবং চুয়াডাঙ্গা ইপিআর এর বাঙালি অফিসার লে. এয়ার আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতের বেতাই ক্যাম্পে ভর্তি হই। পরে ভারতের বিহারে ট্রেনিং গ্রহণ করি। ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের অধীনে ইপিআর কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে কুষ্টিয়া এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করি। এছাড়া সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি মেহেরপুরের বাড়িবাঁকা, মুজিবনগরের মোনাখালী, চুয়াডাঙ্গার ডিঙ্গেদহসহ কয়েকটি স্থানে। মোনাখালীতে সম্মুখ যুদ্ধের সময় আমার বাম হাতে সেলের টুকরো বিদ্ধ হয়। ওই সময় আমি পড়ে যাই এবং আমার সামনের দুটি দাঁত ভেঙে যায়।’

তিনি আরো বলেন- ৬ বছর আগে স্ত্রী আলতাফুন নেছা মারা যায়। এখন সংসারে আছে ছেলে সেলিম (৩৪), মেয়ে নার্গিস (গ্রামে বিয়ে হয়েছে) বৃদ্ধা অসুস্থ মা আজিরন নেছা (৮২)। এছাড়া রয়েছে নাতি-পুতিরা। ছেলের একার আয়ে আর আমার সামান্য ভাতায় সংসার চালানো দুষ্কর। তার ওপর আমরা দুজন অসুস্থ মানুষ। চিকিৎসা ব্যয় যোগাড় করা দুষ্কর। চিকিৎসা ভাতার জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। তাই অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে পারি না।

এদিকে স্ত্রী শহিদা খাতুন, ছেলে কামাল ওরফে নওয়াব, ২ মেয়ে ডলি ও বন্যা আর অসুস্থ বৃদ্ধা মা ফাতেমা খাতুনকে (৮৫) নিয়ে একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলামের সংসার। মেয়ে দুজনকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠিয়েছেন। ছেলে কামাল ওরফে নওয়াব বিবাহিত। সে মাঠে মুনিষ (কামলা/জোন) খেটে সংসার চালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বলেন- ১২ কাঠা জমি লিজ নিয়ে পানচাষ করেছিলাম। কিন্তু অর্থের অভাবে মুনিষ (কামলা/জোন) নিতে পারছি না। তাই পানে কোনো লাভ হবে না। নিজ গতরে খেটে চেষ্টা করছি খরচটা তোলার। আমার নিজের জায়গা জমি নেই। খাস জমিতে বাস করছি। সরকারের কাছ থেকে ওই জমির রেজিস্ট্রি পাইনি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি অনুদানে বাড়ি করে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ৫০ হাজার টাকার দাবি মেটাতে পারিনি বলে আমাকে বাড়ি দেয়া হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম আরো বলেন- উত্তাল ৭১’র মুজিবনগর উপজেলার যতারপুর, মোনাখালী, সদর উপজেলার বারাদী, পাটকেলপোতা, কোলা ও নূরপুর গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে আমি সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছি। এ যুদ্ধ করতে গিয়ে পিঠে গুলি লাগে যা চামড়া ভেদ করে চলে যায়। জীবনের শেষ সময়ে কয়েক বছর আগে আমার প্যারালাইসিস হয়েছিলো। এক বছর আগেও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তারপরেও এক রকম ভালো আছি।

ক্যান্সার আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী ও অসহায় মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম শেষ বয়সে দেখতে চান- মুক্ত চেতনা ও স্বাধীন বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে না অন্যায়-অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি মুক্ত একটি সোনার বাংলাদেশ।