ইসি নিষ্ক্রিয় : বিভ্রান্ত প্রশাসন

 

স্টাফ রিপোর্টার: ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সর্বত্র এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একের পর এক ঘটছে আজব সব কাণ্ড। ভয়-ভীতি ও বাধার কারণে অনেক ইউপিতে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রই জমা দিতে পারেননি। যেন জমা দিতে না পারেন, সেজন্য প্রার্থী রহস্যময় নিখোঁজও হয়েছেন। অনেকে জমা দিলেও চাপের কারণে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কোথাও কোথাও হামলার শিকার হয়েছেন প্রার্থী। পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। আবার স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় ঘেরাও করে অন্যদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেয়া হয়েছে। এ রকম শ শ অভিযোগের পরও নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিষ্ক্রিয়, নির্লিপ্ত। সবকিছু দেখে, জেনে-বুঝেও কমিশন বিভ্রান্ত। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে ইসি নিজেই নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে ধ্বংসের আয়োজন করছে।

প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধা-বিপত্তির ঘটনায় প্রায় পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় থাকার পর, দ্বিতীয় ধাপে এসে অনিয়মের কারণে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে বরখাস্তের সুপারিশ এবং ওই উপজেলার সবকটি ইউপি নির্বাচনের তফসিল বাতিল করায় মনে করা হচ্ছিল, কমিশনের মনে হয় ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু এরপর নানামুখী অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও কমিশন নিশ্চুপ।

ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে গত কয়েক দিনে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর পর্যালোচনায় স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসির নিষ্ক্রিয়তার কারণে স্থানীয় প্রশাসনও অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন ও উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বেপরোয়াও। নির্বাচনের সময় প্রশাসন ইসির অধীনে থাকলেও কার্যত কমিশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে কমিশনের অসহায়ত্ব কাজ করছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে কমিশনের ব্যর্থতা স্পষ্ট।

অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের অতি-উত্সাহী কিছু কর্মকর্তা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের ‘আদেশ-নির্দেশে’ প্রশাসনের অসহায়ত্বও প্রকাশ পাচ্ছে। যেহেতু নির্বাচনের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব ইসির- অথচ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, সে কারণে প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে কি সবকিছু কমিশনের নির্দেশেই ঘটছে? ক্ষুব্ধ নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- প্র্রশাসন ইসির অধীনে থাকায় নৈরাজ্য বেড়েছে! ইসির বদলে বরং সরাসরি সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। কেউ কেউ মোটা বাজেটে এ ধরনের কমিশন লালন-পালনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সভাপতি এম. হাফিজ উদ্দিনের মতে, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে ইসির ব্যর্থতা সুস্পষ্ট। ২০১৩ সালের পর এই কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা এবং মানসম্মত নির্বাচন করতে না পারায় সব ধরনের নির্বাচনেই এখন প্রার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভবিষ্যত্ নিয়েই বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।

বিএনপির পক্ষ থেকে যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে অভিযোগ করেছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ মিলে ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বাধা ও হুমকির কারণে দলের ১৬২ জন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মনোনয়নপত্র জমাই দিতে পারেননি। বিএনপির মনোনীত এসব চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধাদান অথবা জমা দেয়ার পর প্রত্যাহারে বাধ্য অথবা ঠুনকো অজুহাতে প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে।

রিজভী বলেছেন, জনগণকে উপহাস করার জন্য ইসি ব্যালে নৃত্য করছে। নির্বাচন নিয়ে অনাচার ও অনিয়মের ঘটনা সম্পর্কে ইসি নির্বিকার ও  ভ্রুক্ষেপহীন। ফেনীর ফুলগাজীর জিএম হাট ও আনন্দপুর ইউনিয়ন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হিরন, রামশিল, বান্দাবাড়ী, তিনজুরী ইউনিয়ন, বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নে সরকারি দলের হামলা ও বাধার কারণে বিএনপির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি বলেও রিজভী অভিযোগ করেন।

শুধু বিএনপি নয়, ক্ষমতাসীনদের নেতৃত্বে থাকা প্রাক্তন মহাজোট শরিক জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বুধবার গাইবান্ধায় দলীয় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ বলেছেন, ‘আমার নেতা-কর্মীরা আমাকে বলেন, নির্বাচনে গিয়ে কী লাভ! সব তো ক্ষমতাসীনরা নিয়ে নেবে। এখন তো ভোটের আগের রাতেই বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। সরকারকে বলবো- সব নিয়ে যাবেন না, আমাদের জন্যও কিছু রাখবেন।’ নির্বাচন কমিশনের তীব্র সমালোচনা করে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই কমিশন মেরুদণ্ডহীন, অথর্ব, অপদার্থ। ডাক্তাররা নাকি এক্সরে করেও এই কমিশনের মেরুদণ্ড খুঁজে পাননি।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে দেখা করে অনিয়মের অভিযোগ করার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রথম ধাপের ৭৩৮টি ইউপির মধ্যে সাতশর বেশি ক্ষমতাসীনরা নিয়ে যাবে। লোক দেখানের জন্য বিএনপিকে হয়তো ২০-৩০টি দেবে।’ তিনি এ-ও বলেছেন, ‘প্রশাসনের সহযোগিতায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা পুরো নির্বাচনের মাঠ দখল করে রেখেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হচ্ছে।’

ইউপি নির্বাচনে হ-য-ব-র-ল অবস্থা নিয়ে গত রবিবার জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননও। তিনি বলেছেন, ‘প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়নে ইউপি নির্বাচনের সিদ্ধান্তকে আমরা যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলেছিলাম। কিন্তু ইসি তাদের কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। যার কারণে নির্বাচনের পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।’

প্রথম ধাপে ২২ মার্চ অনুষ্ঠেয় ৭৩৮টি ইউপি নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদে ৬৬ জন্য আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন। এরমধ্যে শুধু বাগেরহাট জেলায় ৩৪টি ইউনিয়নে সরকারি দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে  কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন বুধবার এ চিত্র মেলে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় ধাপে ৩১ মার্চ অনুষ্ঠেয় ৬৮০টি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ১৩টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। যার ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ৭৯জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলছেন। অথচ ‘সুজন’এর গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনুষ্ঠিত আগের দুটি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কোনো নজির নেই।

ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থার বিষয়ে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইসি দায়িত্ব পালন করতে পারছে না, এটা স্পষ্ট। নাগরিক হিসেবে আমরা শঙ্কিত। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়বে। এমনতিই দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় এবার অরাজনৈতিক প্রার্থী তেমন নেই। এর ওপর ইসির এরকম ব্যর্থতায় নির্বাচন ব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘ইসির ক্ষমতা অগাধ অথচ তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ইসির কোনো বক্তব্যও কেউ বিশ্বাস করছে না। ইউপি নির্বাচন হচ্ছে জনগণের সবচেয়ে দ্বোরগোড়ার নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে সবসময় প্রান্তিক জনগণ উত্সাহ-উদ্দীপনায় মেতে ওঠে। ব্যাপক অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই নির্বাচনের বড় সৌন্দর্য। কিন্তু সেই সৌন্দর্য এখন ফিকে হয়ে গেছে।’

ইউপি নির্বাচন নিয়ে বৃহস্পতিবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কমিশনের বৈঠকে কমিশন শুধুমাত্র ভোটেরদিন ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও জমাদান থেকে শুরু করে প্রচার-প্রচারণা ও ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে ইসি তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি সব দলের প্রার্থী ও ভোটারের নিরাপত্তার বিষয়টিকেও তেমন গুরুত্ব দেয়নি ইসি। এনিয়ে প্রশাসনেরই কেউ কেউ বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন।