মাজেদুল হক মানিক: ‘প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।’ এই উত্তম কাজটির এখন বড়ই অভাব মেহেরপুরের কৃষি বিভাগে। তা না হলে মেহেরপুরে ক্ষেতের গমশীষ শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? ক্ষতিগ্রস্থ গমচাষিদের অনেকে বলেছেন, প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরামর্শের অভাবে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। তবে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে ব্লাস্ট নামের এক প্রকার ভয়ঙ্কর ছত্রাকের আক্রমণে কোনো প্রতিষেধক দিয়েও কাজ হচ্ছে না।
গমক্ষেতে ব্লাস্টের আক্রমণ দেশে এই প্রথম। তবে চাষিদের অভিযোগ গমের শীষ বের হওয়ার আগ দিয়ে বৃষ্টি হওয়ায় ছত্রাকনাশক ব্যবস্থার বিষয়ে চাষিদের তেমন কোনো ধারণা না থাকায় ব্লাস্ট আক্রমণ ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। বছরের অন্যান্য মরসুমে ফসলে লোকসান হলেও রবি মরসুমের ফসল আবাদ করে লাভের মুখ দেখেন মেহেরপুর জেলার কৃষকরা। এবারে গমের বাম্পার ফলনের আশা করছিলেন চাষিরা। গমের শীষ বের হওয়ার সময় গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বৃষ্টি হয়। এতে গমে ছত্রাক আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিষয়ে কৃষি বিভাগ চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়নি। এতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে ব্যর্থ হন কৃষকরা। চাষিরা জানান, গমের শীষ আসার পর প্রথমে পাতা হলুদ বর্ণ ও কাল কাল দাগ দেখা যায়। কয়েক দিনের মধ্যেই কাল দাগগুলো বড় আকার ধারণ করে ঝলসে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে তা ছড়িয়ে পড়ে শীষে। গমের শীষ আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সাদা হতে থাকে। চাষিরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্বল্প সময়ের মধ্যে গোটা ক্ষেতের শীষ শুকিয়ে যায়। এতে মাঠের পর মাঠের গম ক্ষেত বিনষ্ট হয়ে গেছে। আক্রান্ত ক্ষেতের শীষে কোনো প্রকার দানা হচ্ছে না। ফলে চাষিরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। শুধু জেলায় নয়, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও যশোর অঞ্চলের গমক্ষেতে ব্লাস্ট আক্রমণ করেছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
জেলার প্রায় প্রতিটি মাঠের চিত্র একই। এমন কোনো মাঠ বাদ নেই যেখানে গমের শিষ শুকানোর ঘটনা নেই। এর মধ্যে গাংনী উপজেলার গাড়াডোব, সাহারবাটি, ধানখোলা, হোগলবাড়ীয়া, বাওট, বামন্দী ও তেঁতুলবাড়ীয়া, সদর উপজেলার খোকসা, আমঝুপি, চাঁদবিল, কোলা, মদনাডাঙ্গা গ্রামের চাষিরা উল্লেখযোগ্যভাবে গম আবাদ করে থাকেন। এ সকল গ্রাম চাষিদের রবি মরসুমের প্রধান ফসল বিনষ্ট হয়ে হাজারো চাষির এখন পথে বসার উপক্রম। মুজিবনগর উপজেলার গম চাষিদেরও একই অবস্থা।
গাংনী উপজেলার গাড়াডোব গ্রামের গম চাষি রিপন হোসেন ও আলী হোসেন জানান, তাদের দুজন পৃথকভাবে ৫ বিঘা গম আবাদ করেছেন। ধারদেনা করে ক্ষেতে প্রয়োজনীয় পরিচর্যায় প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ৫-৭ হাজার টাকা। গমের শীষ বের হওয়ার আগ দিয়ে বৃষ্টি হওয়ায় প্রথমে পাতায় দাগ পড়ে। পরবর্তীতে শীষ শাদা হতে থাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সারা ক্ষেতের শীষ শাদা হয়ে যায়। গাড়ডোব গ্রামের মাঠের প্রায় ২শ হেক্টর জমির মধ্যে সবক্ষেতই একই অবস্থা বলে জানান তারা।
একই গ্রামের গম চাষি আবুল কাশেম জানান, ক্ষেতের সব শীষ শুকিয়ে গেছে। শীষ ভেঙে এর মধ্যে কোনো গম পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ক্ষেত ছেড়ে দিয়েছেন তারা। এখন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
সবজি ও রবি ফসলই হচ্ছে মেহেরপুর জেলার অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। গত মরসুমে জেলার ৩টি উপজেলায় ১৭ হাজার ৪১৩ হেক্টর জমিতে গম আবাদ হয়। যার উৎপাদন ছিলো ৭ হাজার ৯১১ মেট্রিক টন। চলতি মরসুমে জেলায় ১৩ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে গম আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৬ হাজার ৩৭৫ হেক্টর, গাংনী উপজেলায় ৬ হাজার হেক্টর ও মুজিবনগর উপজেলায় ১ হাজার ৫শ হেক্টর জমি রয়েছে।
কৃষি বিভাগ ও চাষিরা বলছেন, বারি গম-২৬ এর ক্ষেতে ছত্রাকের আক্রমণ বেশি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে না পারলেও বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোট চাষের প্রায় ৬০ ভাগ ক্ষেত আক্রান্ত হয়েছে। এটিকে চাষিরা মারাত্মক বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে গমে ব্লাস্ট আক্রান্ত দেশ ব্রাজিলের বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা গেছে, ব্লাস্ট আক্রান্ত হলে ৭৫ ভাগ ক্ষেতের গম একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।
এদিকে বুধবার বিকেলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সিটিউটের দিনাজপুর গম গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পরিতোষ কুমার মালাকারের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল গাংনী উপজেলার গাড়াডোবসহ বিভিন্ন মাঠের গমক্ষেত পরিদর্শন করেন। পরদিন ওই দলটি ঝিনাইদহের দত্তনগর খামার ও যশোরের বিভিন্ন গমক্ষেত পরিদর্শন করেন। গমের ব্লাস্ট নামক ছত্রাকের আক্রমণ নিশ্চিত করে তিনি আক্রান্ত ক্ষেতে নাটিভো ও ফলিকর নামের ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আক্রান্ত গমের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যা ল্যাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে পরবর্তীতে কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায় তা ঠিক করা হবে।
শীতকালীন ফসল হচ্ছে গম। কিন্তু চলতি মরসুমে অন্যান্য মরসুমের চেয়ে ১৫ দিন আগেই গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে। তাছাড়া রাত-দিনের তাপমাত্রার বিরাট পার্থক্য দেখা দিয়েছে। এরকম পার্থক্যে রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ সব্বোর্চ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর পরেও কৃষি অফিস বরি ফসলের রোগ-বালাইয়ের প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দিন রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ১২-১৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। চলতি সপ্তাহে এ অঞ্চলে দিনে সব্বোর্চ ৩৩ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও রাত ২টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত সর্বনিম্ন ১৬ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতও রেকর্ড করা হয়। তবে জেলার কৃষি অফিসগুলোতে বৃষ্টিপতা ও তাপমাত্রার পার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়নি।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রার পার্থক্য ও বৃষ্টির কারণে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা জরুরি ছিলো। তাছাড়া বৃষ্টিপাতের পরে রবি ফসলে ছাত্রাকনাশক প্রয়োগ করা না হলে ছত্রাকের আক্রমণ মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। ব্লাস্ট এদেশে নতুন হলেও বৃষ্টি ও তাপমাত্রার পার্থক্য বিবেচনায় প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকলে এটি মহামারী আকার ধারণ করতো না। এটি যদি প্রাকৃতিক দুযোর্গ হয়ে থাকে তাহলে কৃষি অফিসের কাছে কেনো মোকাবেলার প্রস্তুতি ছিলো না সে প্রশ্ন এখন চাষিদের মুখে মুখে।
এ বিষয়ে মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার মোবাইলফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি বোঝার আগেই আক্রান্ত হয়ে গেছে। তাই করণীয় কিছুই ছিলো না। তবে সাধারণভাবে সে সমস্ত ছত্রাকনাশক স্প্রে করার দরকার ছিলো সেটি থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতো কি-না এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
বারি গম-২৬ জাতীয় সীডস বোর্ড (এনএসবি) থেকে ছাড়পত্র পায় ২০১০ সালে। বারীর অধীনে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার পরে গত তিন বছর ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি মেহেরপুর জেলাতেও চাষ হচ্ছে। উচ্চ ফলন ও রোগ-বালাই কম বিধায় এ গম চাষে চাষিদের আগ্রহ বাড়ে। কয়েক বছর চাষ করার পর এ জাতে কীভাবে ব্লাস্ট আক্রান্ত হচ্ছে সে প্রশ্নের সঠিক উত্তর মেলেনি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৫ সালে ব্রাজিলেই প্রথমবারের মতো গমক্ষেত ব্লাস্ট ছত্রাকে আক্রান্ত হয়। পরবর্তীতে এটি ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। তবে ওই দেশগুলোয় প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকায় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পান কৃষকরা।