পদ-পদবী বিহীন জনপ্রতিনিধির গল্প

কুষ্টিয়া প্রতিনিধিঃ পরস্পর নির্ভরশীলতা, সহযোগিতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই সমাজের প্রতি মানুষের ভালবাসা আদিকাল থেকে। নিজের অর্থ কিংবা বিত্ত-বৈভব না থাকলেও মানবিক মন থাকলে জনগনের সেবা করা যায়। এমন নজির রয়েছে অনেকের। সে সব সমাজ সেবকরা কখনো নিজের কিংবা ব্যক্তির প্রচারনার চাইতে সমাজের মানুষের ভাগ্য বদলে কাজ করছেন আত্ম তৃপ্তি থেকে। এমনই এক প্রচার বিমুখ পদ-পদবী বিহীন জনপ্রতিনিধ ও সমাজ সেবক ওমর আলী মেম্বর।
সে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মাজিহাট গ্রামের স্থানীয় সমাজ সেবক মরহুম ছামাদ মন্ডলের ছেলে।
একান্নবতী ও সংখ্যাবহুল পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারনে মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ শেষ করা সম্ভব না হলেও বাবার হাতেই সমাজ সেবার হাতখড়ি তার ছোট বেলায়। একারনেই ছোট বেলা থেকেই সামাজিক বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে জড়িয়ে পড়ে সে। সমাজের মানুষের বিপদে কিংবা অসুখ-বিসুখে শোক বিহ্বল পরিবারের তাৎক্ষণিক অভিভাবক হয়ে ওঠা তার স্বভাব সুলভ আচরণ। একই সাথে সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও রয়েছে তার সুনাম। আশির দশকের দিকে তিনি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার স্থানীয় সংগঠক, তুখোড় মঞ্চ অভিনেতা ও চৌকস কলাকুশলি হিসেবে একাধিক যাত্রাপার্টি ও সাধারণ দর্শক শ্রোতাদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। এভাবেই স্থানীয় স্বেচ্ছা-সেবক সমাজকর্মী ওমর আলী হয়ে ওঠেন যাত্রামঞ্চ কাঁপানো সাংস্কৃতিক কর্মী।
নিজ গ্রামের সাধারন মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে ওমর আলী জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় রাজনীতিতে। এসময় তিনি প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা সৈয়দ নিজাম উদ্দীন লাইট ও তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম এ্যাডভোকেট আশরাফের উদ্দিনের ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন।
তৎকালীন সময়ে আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনার সাথে কুষ্টিয়ার মিরপুরে সৈয়দ নিজাম উদ্দীন লাইটের বাসভবনে সাক্ষাতের মাধ্যমে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী রাজনীতির সাথে।
অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারনে স্বল্প শিক্ষিত এ মানুষটি স্থানীয়দের অনুরোধে ১৯৯৮ সালে মিরপুর উপজেলার কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিরঙ্কশ সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোটের ব্যবধানে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন।
এসময় অত্র এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, অপহরণ-চাঁদাবাজী ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। তিনি এলকার সাধারন মানুষের জন্য রাত জেগে গ্রাম পাহারার লক্ষ্যে স্থানীয় গ্রাম্য প্রধান ও সাধারণ জনতার সমন্বয়ে গড়ে তোলেন গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের তৎপরতার বিরুদ্ধে জনতার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তাকে ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারী মধ্যরাতে অপহরণ করে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি।
অপহরণকারীরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর এবং মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলায় ৫দিন আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে মৃত্যৃর মুখে টেলে দেয় তাকে।
সে সময় মুত্যুর মুখে পতিত ওমর আলী মেম্বরকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রশাসনিক বল প্রয়োগ করে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে উদ্ধারে সহযোগিতা করেন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামীলীগের তৎকালিন সভাপতি (বর্তমান সাংসদ ও হুইপ) সোলায়মান হক জোর্য়াদ্দার সেলুন, মাহবুব উল আলম হানিফ (বর্তমান সাংসদ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক) ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নিজাম উদ্দীন লাইট।
সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দলমতের উর্দ্ধে থাকার কারনে তিনি ২০০৩ সালে ও ২০১১ সালে আবারো তিনি ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়ে একটানা প্রায় ১৯ বছর ধরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। জন সম্পৃক্তার কারনে তিনি স্থানীয় শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠাসহ সামাজিক কর্মকান্ডের উন্নয়নে অবদান রেখেই চলেছেন।
বিগত দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়ার মিরপুর-ভেড়ামারা আসনের বিএনপি সাবেক সাংসদ অধ্যাপক শহীদুল ইসলামের বিপরীতে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী মাহবুব-উল-আলম হানিফ নির্বাচনী যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। এসময় অধ্যাপক শহীদুল ইসলামের প্রভাব ও শক্তির কাছে মিরপুরের একাংশে যুৎসই নির্বাচনী প্রচারনাই জমে উঠতে পিছিয়ে পড়েন আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী মাহবুব-উল-আলম হানিফ। সে সময় ওমর আলী মেম্বর সাংগঠনিক তৎপরতা মাধ্যমে ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় মিরপুরের ছাতিয়ান, কুর্শা আমবাড়ীয়া ও মালিহাদ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগেন নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমন্বয় করে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী মাহবুব-উ-আলম হানিফের পক্ষে ঐ সব অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারনায় গণজোয়ার সৃষ্টি করেন। এভাবে মাহবু-উল-আলম হানিফের নিকট একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রিয় হয়ে ওঠেন ওমর আলী মেম্বর।
আওয়ামীলীগের বিভিন্ন কর্মী মন্ত্রী-এমপির সাথে ফটো ফ্রেমে আবদ্ধ হয়ে শারীরিক অবস্থার উন্নয়ন করলেও প্রচার বিমুখ এই জনপ্রতিনিধি দীর্ঘ দিন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও আর্থিক অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। যে কারনে একমাত্র পুত্র সন্তানকে ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে শ্রমিক ভিসায় পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দলমতের উর্দ্ধে থাকার কারনে স্থানীয়দের অনুরোধে পুনরায় আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মিরপুর উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এই তৃণমূলের নেতা ওমর আলী।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জন্য নিবেদিত প্রাণ হওয়া সত্বেও এই পদ-পদবী বিহীন জনপ্রতিনিধির সৌভাগ্য হয়নি আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতিক নিয়ে নির্বাচন করার। তবে এলার সাধারন মানুষের অনুরোধে পদে মশাল প্রতীকে লড়ছেন এই নেতা।
আর তার এই নির্বাচনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন স্বয়ং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। যে কারনে জেলা ও উপজেলা জাসদ নেতৃবৃন্দ এখন কুর্শা ইউপির নির্বাচনী মাঠে তার পক্ষে। জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুল্লাহ, জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মহসীন, সাধারন সম্পাদক আবদুল আলিম স্বপন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক কারশেদ আলীর রাজনৈতিক নির্দেশনায় ও উপজেলা জাসদের সভাপতি শরীফ, সম্পাদক আহম্মদ আলীসহ সর্ব স্তরের জনগণের সাথে জাসদ কর্মীদের নিয়ে নিরলস প্রচারনা চালাচ্ছেন তিনি।
এবারের নির্বাচনে ওমর আলী মেম্বর ছাড়াও কুর্শা ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন সাবেক দুই ইউপি চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির শামসুল আলম ও আওয়ামীগের আব্দুল হান্নান। এছাড়াও রয়েছে জামাত কর্মী বলে পরচিতি আবদুর রাজ্জাক ও বিএনপি কর্মী বলে খ্যাত আল আমিন।
তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মানবদরদী এই জাসদ প্রার্থী ওমর আলী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে পারে এমন মন্তব্য স্থানীয়দের।
ওমর আলী মেম্বর জানান, নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকবেই। আমি আশা করি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আর জনগণ যদি আমার পাশে থাকে তাহলে আমি জনগণের আরো সেবা করার সুযোগ পাবো। আমি চেয়ারম্যান হতে চাই না, আমি একজন চেয়ারম্যান নামের সেবক হতে চাই। এলাকার গরীব দুঃখীদের সেবা করতে চাই।