রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার একমাত্র দাবি মেহেরপুরের জীবিত দু ভাষা সৈনিকের

মহাসিন আলী: মেহেরপুর জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের ধর্ণাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান নজির হোসেন বিশ্বাস। ফয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস ও সরসী নেছা বিবি’র নয় সন্তানের মধ্যে প্রথম নজির হোসেন বিশ্বাস। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ১৯৫১ সালে মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এদিকে মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজার শহীদ গফুর সড়কের বাসিন্দা এস্কেন্দার জুলকার নাইন ও খালেছা খাতুনের ১১ সন্তানের মধ্যে বড় মহা. ইসমাইল হোসেন। তিনি ১৯৫১ সালে মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলের ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
১৯৫১ হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তারা ভাষার জন্য লড়াই করে পুলিশি নির্যাতন সহ্য করেছেন। অবশেষে তারাসহ ওই স্কুলের ৭ জন ছাত্র পান রাজ টিকিট। যে কারণে ধর্ণাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও নজির হোসেন বিশ্বাসের শিক্ষা জীবন নষ্ট হয়ে যায়। ইসমাইল হোসেন দারিয়াপুর হাই স্কুলে ভর্তি হয়েও নির্যাতনের শিকার হন। তার পরও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং স্নাতক পাস করেন। ২০১০ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ দুজন প্রতি বছর ভাষা সৈনিকের সম্মাননা পেয়ে আসছেন। ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক নজির হোসেন বিশ্বাস এবং এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক ইসমাইল হোসেন মৃত্যুর পূর্বে তারা ভাষা সৈনিকের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান। সরেজমিনে পিরোজপুর গ্রামে গিয়ে নজির হোসেনের বড় ছেলে মাসুদ বিশ্বাসের সহযোগিতায় তার সাথে সাক্ষাতকার নেয়া হয়। এছাড়া শহরের টি অ্যান্ড টি সড়কের বাসভবন থেকে ইসমাইল হোসেনের সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। আমাদের প্রিয় পাঠকদের জন্য তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
মাথাভাঙ্গা: জনাব নজির হোসেন বিশ্বাস আপনি কেমন আছেন? ১৯৫২ সালে আপনার বয়স কতো ছিলো? আপনি কোন শ্রেণির ছাত্র ছিলেন?
নজির হোসেন বিশ্বাস: ৮৬ বছর বয়সে আর ভালো থাকা যায়? আমি এখন অসুস্থ। স্ত্রী-সন্তানদের সহযোগিতা নিয়ে কোনো রকম চলাফেরা করছি। ১৯৫২ সালে আমার বয়স ছিলো ২২ বছর। তখন আমি মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলে ৭ম শ্রেণির ছাত্র এবং থাকতাম শহরের মুসলিম হোস্টেলে।
মাথাভাঙ্গা: ভাষা আন্দোলনের জন্য আপনার করণীয় কি ছিলো? প্রশাসন আপনাদের বিরুদ্ধে কেমন ভাবে অবস্থান নেয়?
নজির হোসেন বিশ্বাস: তদানিন্তন পাক-সরকারের চাপিয়ে দেয়া ঊর্দু ভাষার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ঢাকার ৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। এতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক ও জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে শহীদ হন। ২২ শে ফেব্রুয়ারি খবরটা মেহেরপুর পৌঁছালে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা মিছিল বের করি। এর পর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। ৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস পালনের জন্য মিছিল মিটিং ও পোস্টারিং করি। পুলিশ এতে বাধা দেয় এবং লাঠি চার্জ করে মিছিল মিঠিং ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একই অপরাধে নেতৃত্বদানকারী আমিসহ আমাদের ৭ জনকে পুলিশ আটক করে থানায় নেয়। স্থানীয় জামিনদারদের সুপারিশে রাতে জামিন পাই।
মাথাভাঙ্গা: এর পর আর বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি? পরবর্তীতে আপনাদের ভাগ্যে কি জোটে?
নজির হোসেন বিশ্বাস: ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস পালনে মিছিল মিটিং ও পোস্টারিং করতে পুলিশ কোন বাধা দেয়নি। ১৯৫৫ সালে তখন আমি ১০ম শ্রেণির ছাত্র। ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস পালনের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ উপেক্ষা করে মহান শহীদ দিবস পালন করার অপরাধে ওই দিন রাতের খাবার খাওয়ার সময় পুলিশ আমাদের ৭ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে নিয়ে কোর্টের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি আইনী লড়াইয়ের পর আমরা ৭ জন ছাত্র মুক্তি পাই। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য ছিলো। আমাদের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) সাবদার আলী ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। যে কারনে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে তিনি আমাদের ৭ জনকে রাজ টিকিট দিয়ে বহিস্কার করেন। এর পরে আর কোন স্কুলে পড়ার সুযোগ না পেয়ে আমার শিক্ষা জীবন একেবারে নষ্ট হয়ে যায়।
মাথাভাঙ্গা: দীর্ঘ জীবন আপনার কিভাবে কেটেছে?
নজির হোসেন বিশ্বাস: ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পিরোজপুর শাখা পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার ছিলাম। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পিরোজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ২০০৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মেহেরপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছি দীর্ঘ জীবনে। পিরোজপুর গ্রামের সংখ্যা লঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার মত জায়গা ছিলোনা। তাই ২০০৭ সালে আমি আমার বাড়ির পাশে নিজের নামীয় ৫ কাঠা জমি মন্দির কমিটির নামে রেজিষ্ট্রি করে দেই। ২০১১ সালে ব্রেন স্টোকে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছি।
মাথাভাঙ্গা: জনাব ইসমাইল হোসেন আপনি কেমন আছেন? ভাষা আন্দোলনের সময় আপনি কোন শ্রেণির ছাত্র ছিলেন? তখন আপনার বয়স কত ছিল? আর এখন আপনার বয়স কত হবে?
ইসমাইল হোসেন: আমি এক প্রকার ভালো আছি। ১৯৫১ সালে আমি মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলের ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। আমার বয়স তখন প্রায় ১৬ বছর হবে। আর বর্তমানে আমার বয়স ৮০ বছর হবে।
মাথাভাঙ্গা: আপনারা দুজনেই ভাষা আন্দোলনের সময় পঠিত শ্রেণি অনুযায়ী বয়স অনেক বেশি বললেন। এটাকি সরকারি বিধি বহির্ভূত ছিলোনা?
ইসমাইল হোসেন: আসলে সে সময় দেশের কয়টি পরিবারের ছেলে-মেয়েরা লেখা-পড়া করত আর দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কয়টা ছিলো? তখনকার দিনে বয়সের বার ছিলোনা। এখন যেমন ঘরে ঘরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে সরকার নির্ধারিত বয়স লাগে। তার পরও ৩ বছর থেকে ৪ বয়সের শিশুদের কিন্ডার গার্টেন স্কুলে ভর্তি করে মায়েরা স্কুল আঙিনায় বসে থাকেন। এটা আমাদের জন্য আশার কথা হলেও তখনকার দিনে এধরণের সুযোগ ছিলোনা। তাই ছেলেরা অনেক বয়স হলেই স্কুল মুখী হত।
মাথাভাঙ্গা: ভাষা আন্দোলনের কোন কোন স্মৃতি আপনার মনে পড়ে?
ইসমাইল হোসেন: বড় ভাই নজির হোসেন বিশ্বাস যে কথাগুলো বলেছেন তার সবকিছুই আমার মনে পড়ে। আরো মনে পড়ে- যখন আমরা ৭ জন ছাত্র আটক হই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের গুরু সাজা দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। তখন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক (একজন নন ব্যাঙ্গুলী) মেহেরপুর মহাকুমাতে আসেন। তার আসার সংবাদে আমাদের অভিভাবকরা রাস্তা ব্যারিকেড করতে রাস্তার উপর শুইয়ে পড়েন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে অভিভাবকদের কথা শোনেন এবং আমাদের যাতে বড় ধরণের (গুরু) শাস্তি দেয়া না হয় সেই ব্যবস্থা করেন। এরপর আমরা জামিনে মুক্তি পাই।
রাইজিং বিডি: ভাষার জন্য লড়তে আপনারা যে ৭ জন বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হন তাদের নাম কি? তারা এখন কে কোথায় আছেন? তাদেরকে মেহেরপুরের মানুষ ভাষা সৈনিক হিসেবে স্মরণ করেন কি না?
ইসমাইল হোসেন: ভাষার জন্য অনেকে তখনকার দিনে আমাদের সাথে কম বেশি মিছিল মিটিংএ অংশ গ্রহণ করেছিলো। তবে পুলিশি নির্যাতনের ভয়ে অনেকে পিছিয়ে গিয়েছিলো। চিহ্নিত আমরা ৭ জন নির্যাতনের শিকার হই ও একাধিকবার কারাভোগ করি। সাত জনের মধ্যে ছিলাম মেহেরপুর শহরের আমি, পিরোজপুর গ্রামের নজির হোসেন বিশ্বাস এবং মেহেরপুর শহরের বিভিন্ন এলাকার সামছুল আলা, কদম রসুল, আবুল কাশেম আঙ্গুর, গোলাম কবীর খান ও মোশারফ হোসেন। আমি আর বড় ভাই নজির হোসেন বিশ্বাস বেঁচে আছি। বাকিরা সবাই মারা গেছেন। তাদের সরকার ভাষা সৈনিকের মর্যাদা দেইনি! তবে মেহেরপুরের মানুষ কেন দেবেন? মেহেরপুরে অনেকের ইচ্ছা ওরা কেন ভাষা সৈনিকের মর্যাদা পাবেন? আমরা পেলে ভালো হত। এ মানষিকতা নিয়ে বিরোধে মেতে থাকার চেষ্টা করেন। তবে স্থানীয় সংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের সাথে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আমাদের ৭ জনকে ভাষা সৈনিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচার করেছেন।
মাথাভাঙ্গা: সরকারিভাবে আপনারা ভাষা সৈনিকের মর্যদা কিংবা সম্মাননা পেয়েছেন কি?
ইসমাইল হোসেন: না সরকারিভাবে ভাষা সৈনিকের মর্যদা আমরা পায়নি। তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের লেখা-লেখির কারণে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় ২০১০ সালে তার নির্দেশে মেহেরপুর জেলা প্রশাসন আমাদের দুজনকে ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মাননা দেয়া হয়। এর পর থেকে জেলা প্রশাসন, মেহেরপুর মৃত্তিকা গ্রুপ থিয়েটার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মক্কর স্মৃতি পাঠাগারসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
মাথাভাঙ্গা: আপনার সময় কিভাবে কেটেছে বা কাটছে?
ইসমাইল হোসেন: আমি বরাবরই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। তাই রাজনীতি আর সমাজ সেবার মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ সময় পার করেছি। আমি মাত্র দেড় বছর একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেছি। ভালো লাগেনি তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমি বিভিন্ন সময়ে মোট ২৯ বছর মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৩ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মানিত উপদেষ্টা হিসেবে আছি। বর্তমানে আমি অসুস্থ। ওষুধ খেয়ে কোনো রকম টিকে আছি। এর পরও যখন ওষুধ কেনার টাকা পাই না তখন ওষুধ খেতে পারি না।
মাথাভাঙ্গা: জনাব নজির হোসেন বিশ্বাস ও জনাব ইসমাইল হোসেন শেষ জীবনে আপনাদের দাবি কী?
নজির হোসেন বিশ্বাস ও ইসমাইল হোসেন: জীবন সায়াহ্নে আমাদের সরকারের কাছে একটি মাত্র চাওয়া- ‘সারাদেশের শতাধিক জীবিত ভাষা সৈনিককে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক।’