মুক্তিযোদ্ধার সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত শহীদ হামিদার রহমানের পরিবার

???????????????????????????????

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পার হেও কেউ কথা রাখেনি

রহমান মুকুল/শরিফুল ইসলাম রোকন: দীর্ঘ ৪৫ বছরেও সম্মানি ভাতাসহ সমুদয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন শহীদ হামিদার রহমানের পরিবার। এ অভিযোগ করে পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে মহান এ শহীদ পরিবারকে সমবেদনা প্রকাশ করে টাকাসহ চিঠি পাঠালেও পরবর্তীতে আর কারও দায় পড়েনি খোঁজটুকু রাখার। দীর্ঘ কয়েক যুগ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার এ পরিবারটি মানবেতর দিনযাপন করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সরকার কেউই খোঁজটুকুও রাখেনি। এমনকি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কোনো সহযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযোদ্ধা নেতাও কখনও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেননি। বরং নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থেকেছেন সকলেই।

বহু ত্যাগ- তিতিক্ষা ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। একদিকে এ ইতিহাস যেমন জলদগম্ভীর বেদনাদায়ক, তেমনি আবার অম্লান গৌরবগাঁথা। এক সাগর রক্ত আর লাখো শহীদের রক্তের দামে কেনা এ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। স্বাধীনতা নামের সেই কাঙ্ক্ষিত লাল সূর্যটি ছিনিয়ে আনতে এদেশের ছাত্র যুবক জনতাসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ জীবনবাজি রেখে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তির সংগ্রামে। দেশ মাতৃকার জন্য আত্মদানকারী এমনি এক শহীদ সেনানীর নাম হামিদার রহমান। চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর উপজেলার বটিয়াপাড়া গ্রামের মৃত আফছার আলীর ছেলে তিনি। ঐতিহাসিক ৭১’ সালে তিনি ছিলেন টগবগে যুবক। নব বিবাহিত স্ত্রীর অপরিমেয় প্রেম, পিতা-মাতার অতুলনীয় স্নেহের বন্ধনসহ পরিবারের সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অন্যদের সাথে ভারত থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আলমডাঙ্গাসহ চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেছেন বীরদর্পে। এরই এক পর্যায়ে পাক সেনার গুলিতে তিনি শহীদ হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আর বীরদর্পে সম্মুখ যুদ্ধে আত্মোৎস্বর্গকারী শহীদ রফিকুল ইসলামের অবহেলিত পরিবার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞার যেন এক বেদনাদায়ক উদাহরণ।

শহীদ হামিদার রহমান যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন তখন তার স্ত্রী আবেদা খাতুন ৮ মাসের অন্তঃস্বত্তা ছিলেন। স্বামীকে হারিয়ে অন্তঃস্বত্তা গৃহবধূ আবেদা খাতুন অকূল পাথারে পড়েন। কয়েক মাসের মাথায় বিধবার কোল জুড়ে আসে পুত্রসন্তান। সন্তানের নাম রাখেন আলিম। সীমাহীন অভাবের সংসারে শিশুসন্তানকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে সন্তানসহ চলে যান পিতার বাড়ি আলমডাঙ্গার ভোদুয়া গ্রামে। আবেদা খাতুনের পিতা-মাতাও খুব দরিদ্র। তারপরও পেটের সন্তান, ফেলে তো আর দিতে পারেন না! এক বেলা খেয়ে না খেয়ে তাদের সংসারেই থাকতে হয়েছে। দীর্ঘ এতো বছর সন্তানকে নিয়ে দুর্বিসহ জীবন শুরু হয় বিধবার। বিধবা আবেদা খাতুনের জীবন যেন অব্যক্ত যন্ত্রণা আর সীমাহীন লাঞ্ছনার প্রতিচ্ছবি।

শহীদের বিধবা স্ত্রী ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানান, স্বাধীনতাত্তোর প্রায় ২ যুগেরও বেশি সময় কেটেছে তাদের অনাহার-অর্ধাহার আর রোগ-শোকের বিরামহীন ঝঞ্ঝার মধ্যদিয়ে। একদিকে আর্থিক দৈন্যদশা, অন্যদিকে দরদী কোনো পৃষ্ঠপোষকের অভাবে একমাত্র ছেলেকেও লেখাপড়া করাতে পারেননি। ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর পুষ্টিহীনতা ছিলো নিত্য সাথী। কিশোর বয়স থেকেই জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে ছেলেকে। দু মুঠো ভাতের আর একটু সুখে থাকার স্বপ্নও বার বার হোঁচট খেয়েছে সমাজের অবজ্ঞা আর অবহেলার কাছে।

শহীদের বিধবা স্ত্রী ক্ষোভ ও অভিযোগের সুরে জানান, মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দেয়া কত মানুষ  সরকার থেকে বরাদ্দকৃত প্লট, ফ্ল্যাট, তাদের পরিবারের পুনর্বাসন ইত্যাদিসহ বহুবিধ লোভনীয় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার নিচ্ছে। অথচ আজ পর্যন্ত তারা এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। তারাই শুধু অবহেলিত আর নিগৃহীত থেকে গেছে। এতো কষ্টেও তাদের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। এখনো পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। বর্তমানে তারা অর্থনৈতিক দুর্মূল্যের এই বাজারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সহায় সম্বলহীন ও ভূমিহীন এ পরিবারটি বাড়ির যে ঘরে অবস্থান করে, তা যেন ঘর নয়, ঝুপড়ি।

অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে তিনি বলেন, সরকারের কোনো লোক কিংবা মুক্তিযোদ্ধা তাদের খোঁজ নেয়নি। স্বামী শহীদ হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ২ হাজার টাকা আর একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনা তিনি কোনো দিন ভুলতে পারেননি। চিঠিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন-‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইলো আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশ প্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহাকুমা প্রশাসকের নিকট ২ হাজার টাকার চেক প্রেরিত হলো। চেক নং ৯০০৫৮৯৮৮। আমার প্রাণভরা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।’ শেখ মুজিব (স্বাক্ষর)। বঙ্গবন্ধু এ মহান শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে সম্মান দেখালেও এখন কেউ নেই এতোটুকু করুণা করার। মুখে মুখে নেতারা বঙ্গবন্ধুর জন্য সার্বক্ষণিক প্রাণপাত করলেও তার আদর্শ মেনে চলতে চায় না কেউ।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতার আবেদন কখনও জানিয়েছেন কি-না জিজ্ঞাসা করলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বলেন, আগে অনেক চেষ্টা তদবির করেছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা নেতার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, কিন্তু কেউ কিছু করেনি। সবাই মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট চেয়েছে। কিন্তু শহীদ পরিবারের নিকট সে সার্টিফিকেট নেই। শুধু আছে বঙ্গবন্ধুর চিঠি আর দর্শনা চিনিকল প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ড কর্তৃক প্রকাশিত বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। যেখানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হামিদার রহমানের নাম রয়েছে। শুধু সার্টিফিকেট থাকবে আর বঙ্গবন্ধুর চিঠির কি কোনো দাম নেই? এ প্রশ্ন  স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎস্বর্গকারী মহান বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বয়োবৃদ্ধা স্ত্রী আবেদা খাতুনের।