স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা গত সোমবার রাতের শিলা-বৃষ্টিতে ইটভাটা ও ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রবীণ কৃষকরা বলছেন, স্মরণকালে শীতের সময় এমন বৃষ্টিপাত তারা কখনই দেখেননি। আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে চুয়াডাঙ্গায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গা পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক তহমিনা নাসরিন জানান, সোমবার রাত ৭টা ৫৫ মিনিট থেকে ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত মোট ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, শিলা-বৃষ্টিপাতের ফলে পেঁয়াজ, রসুন, গম, ভুট্টা, মসুরি, আলু ও পানবরজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া, আখ ও তামাকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আগামী সোমবার নাগাদ ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বলা সম্ভব হবে।
এদিকে চুয়াডাঙ্গা সদর ও দামুড়হুদা উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মাঠে মাঠে শীতকালীন ফসল, গম, আলু, মসুরি ও আখের ব্যাপক ক্ষতি দেখা গেছে। এছাড়া কোনো কোনো ইটভাটায় প্রায় ১০ লাখ টাকা পরিমাণের ইট ভিজে কাদা হয়ে গেছে। দামুড়হুদা উপজেলার পুড়াপাড়ায় রাজা ব্রিকস এবং এমএমই ইটভাটার মালিক ইকবাল মাহমুদ টিটু জানান, তার দুটি ইটভাটায় ২০ লাখ টাকার ইট পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে। জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব দাবি করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলার ৮৪ ইটভাটায় ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার ইট বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে। ভাটামালিকদের সহযোগিতা করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন তিনি।
দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুফি মো. রফিকুজ্জামান জানান, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোসহ উপজেলা এলাকায় পেঁয়াজ, রসুন, গম ও আলুসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহেদুল ইসলাম জানান, পূবালি বায়ুর প্রভাবে এই বৃষ্টিপাত হয়েছে।
দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদায় শীলাবৃষ্টিতে আমের মুকুল, পানের বরজসহ মাঠে থাকা বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে শ শ বিঘা ধানক্ষেত। গত সোমবার রাত ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্য়ন্ত প্রায় দু ঘণ্টাব্যাপি ওই শীলাবৃষ্টি হয়। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এলাকার অধিকাংশ পানবরজ এবং আমের মুকুল শিলায় নষ্ট হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ধানের জমি পানিতে হাবুডুবু অবস্থা। এছাড়া পেপে বাগান, ভুট্টা ও গমের ক্ষেত বিনষ্ট হয়ে মাটির সাথে লুটোপুটি খাচ্ছে। এছাড়া কাদিপুর মরগাং এ রোপণকৃত প্রায় দশ বিঘা জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সবমিলিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, বৃষ্টিতে জীবননগর উপজেলার ৪টি গ্রামের মাঠে উঠতি ফসলের ক্ষতিসাধন হয়েছে। উপজেলার উথলী, সেনেরহুদা, একতারপুর ও মৃগমারী গ্রামে বৃষ্টিপাতের ফলে কলা ও ভুট্টাক্ষেতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি। তবে ক্ষতির পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা কৃষি অফিস দিতে পারেনি।
উপজেলার সেনেরহুদা গ্রামের ভুট্টাচাষি আবুল কালাম আজাদ জানান, তার দেড়বিঘা ক্ষেতের অধিকাংশ ভুট্টা গাছের মাজা ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। সেই সাথে ক্ষতি হয়েছে ফলন্ত ভুট্টার মোচাও। বৈদ্যুতিক লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত লাইন মেরামত করে গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়।
আন্দুলবাড়িয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়া এলাকায় গত সোমবার রাত ৮টার দিকে মুষলধারে শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়িসহ কৃষকের উঠতি ফসল ভুট্টা, গম, মসুরি, কলা, কুল, আমের মুকুলসহ সবজি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একমাত্র অর্থকরি ফসল হারিয়ে এলাকার কৃষকরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের চাষি মোল্লা আলতাব হোসেন ফেলা জানান, আশা ছিলো দু বিঘা ভুট্টা ও কলা বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করাবো। সে আশা ও স্বপ্ন আমার সব বিলীন হয়ে গেলো। আন্দুলবাড়িয়া স্টেশনপাড়ার রুস্তম, কাওড়াপাড়ার মিলন ও ডুমুরিয়া গ্রামের সেলিম অভিন্ন ভাষায় আক্ষেপ করে বলেন, মরসুমি আগাম কলাবাগান কিনে সব হারিয়ে এখন সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছি। মাঠের উঠতি ফসলাদি ক্ষয়ক্ষতির কারণে এলাকার সকল কৃষকের মাঝে হতাশ লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও এলাকার কাঁচাপাঁকা ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে বলে জানা গেছে।
মুজিবনগর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, হঠাৎ শিলাবৃষ্টিতে মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলায় রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উঠতি ফসল পেঁয়াজ, মসুর, ভুট্টা ও আলুক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। এতে ফসলে পচন ধরে বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা। গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে মেহেরপুরে হঠাৎ করে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি আবার কখনও প্রবলবেগে বৃষ্টি হয়। গভীর রাত পর্যন্ত থেমে থেকে বৃষ্টি নামে। এতে মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর, মোনাখালী, দারিয়াপুরসহ জেলার বিভিন্ন মাঠের পেঁয়াজ, মসুর, আলু ও ভুট্টাক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। এছাড়াও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে এসব মাঠের অন্যান্য ফসল।
চাষিরা জানান, জমি থেকে পানি নামতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগবে। এখন কৃষকদের পেঁয়াজ ঘরে তোলার সময় চলছিলো। পানি নিষ্কাশন না হলে ফসলও তুলতে পারবেন না তারা। এভাবে কয়েকদিন পড়ে থাকলে জমিতে পেঁয়াজে পচন ধরতে পারে। এছাড়াও মসুর ও ভুট্টার ফল আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু শিলাবৃষ্টিতে মসুর গাছও পচন ধরার আশঙ্কা রয়েছে। একই অবস্থা হতে পারে ভুট্টা ও আলুর ক্ষেত্রে। এতে জেলার রবি ফসলের ফলন বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে জানালেন কৃষকরা।
গোপালনগর গ্রামের চাষি রফিকুল ইসলাম ও ফজলুল হক জানান, তাদের চার বিঘা পেঁয়াজ ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। শিলাবৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ গাছ ভেঙে পড়েছে। ক্ষেতের বেশির ভাগ জায়গায় পেঁয়াজ গাছ মাটির সাথে নুইয়ে পড়েছে। এতে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা।
চাষিরা জানান, মসুর ক্ষেতে এখন ফুল থেকে ফলে রূপান্তরের পর্যায়ে রয়েছে। ক্ষেতের ৫০ ভাগ মসুরে ফল এসেছে। বাকি মসুর গাছে ফুল পর্যায়ে রয়েছে। তাই শীলাবৃষ্টিতে মসুরের ফুর ঝরে পড়েছে। এতে ফলন বিপর্যর দেখা দেয়ায় চাষিরা ব্যাপক লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছেন।
মুজিবনগর উপজেলার প্রধান অর্থকরি ফসলের মধ্যে সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ অন্যতম। এ উপজেলার প্রায় ২ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে এবারের সুখসাগর পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। সপ্তাখানেক আগে থেকে পেঁয়াজ উত্তোলন শুরু করেন চাষিরা। চলতি মরসুমে বিভিন্ন কারণে পেঁয়াজের ফলন কমেছে। ফলন তোলার ভরা মরসুমে বৃষ্টির কারণে এখন দিশেহারা পেঁয়াজ চাষিরা।
জেলায় চলতি মরসুমে ৯ হাজার হেক্টর গম, ১২ হাজার হেক্টর জমিতে মসুর ও ৩ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। মুজিবনগর উপজেলা কৃষি অফিসার মোখাফখারুল ইসলাম জানান, সকাল থেকে বিভিন্ন মাঠে উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি পরিদর্শন করেছেন। পানি নিষ্কাশন ও রোগ উঠলে ক্ষতি কমে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পানিতে ফসল ডুবে থাকলেও রোদ উঠলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। আবহাওয়ার পরিবর্তন না হলে গোড়া পচা রোগে আক্রান্ত হতে পারে মাঠের ফসল। মাঠ পর্যায়ে উপজেলা পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পরিদর্শন করে ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করবেন। সব ব্লকের প্রতিবেদন পেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা যাবে।
চুয়াডাঙ্গায় বৃষ্টিতে ইটভাটা ও ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি : ৬ কোটি টাকার ইট পানিতে ভিজে নষ্ট
