রহমান মুকুল/ শরিফুল ইসলাম: এক গুচ্ছ রঙ-বেরঙের বেলুন উড়িয়ে আলমডাঙ্গা জনপদের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী আলমডাঙ্গা বহুমুখী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২ দিনব্যাপি শতবর্ষপূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেলেন জাতীয় সংসদের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপি। দু দিনব্যাপি আনন্দঘন এ মিলন মেলায় দেশ-বিদেশে অবস্থানকারী এ বিদ্যালয়ের বহু খ্যাতিমান প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছুটে এসে যোগ দিচ্ছেন। পুরো আলমডাঙ্গা শহর জুড়ে উপচে পড়ছে উৎসবের আমেজ, উতুঙ্গ আনন্দ যাপনের ফল্গুধারা।
গতকাল ছিলো ২২ জানুয়ারি শুক্রবার প্রাণের উৎসবের কাঙ্ক্ষিত লগ্ন। আনন্দযজ্ঞের প্রধান অতিথি হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনকে পুরোভাগে নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টায় বর্ণাঢ্য ৱ্যালির মাধ্যমে শুরু হয় বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণ। ৱ্যালি শেষে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন হুইপ মহোদয়। কয়েকটি পর্বে অনুষ্ঠানমালা সাজানো হয়। ১ম অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আওরঙ্গজেব মোল্লা টিপু। প্রধান অতিথি ছিলেন হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বৈদ্যুতিক উপদেষ্টা ও প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শক ও বিদ্যুত লাইসেনিং বোর্ডের চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব আবুল কাশেম, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুস, আলমডাঙ্গা উপজেলা চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দীন, আলমডাঙ্গা পৌর মেয়র হাসান কাদির গনু, চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম খান।
প্রভাষক একেএম ফারুক ও তাইমুন নাহার মিমের উপস্থাপনায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক উপসচিব লুতফর রহমান জোয়ার্দ্দার, রাজউকের ট্যাক্সেস অফিসার নাসির উদ্দীন, মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা কমান্ডার আব্দুল হান্নান, সাবেক কমান্ডার (পিএসসি-নেভী) সহিদুর রহমান, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার শফিউর রহমান সুলতান জোয়ার্দ্দার, আফিল উদ্দীন মাস্টার, আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন, সাবেক প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম, সাবেক মৎস্য কর্মকর্তা মীর আব্দুল হামিদ চৌধুরী, সাবেক আনসার ভিডিপি পরিচালক আবুল কাশেম, মুক্তিযোদ্ধা মইন উদ্দীন, প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দীন, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি অ্যাড. সোহরাব হোসেন, ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শহিদুল হক মোল্লা শিপলেন, মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষক খন্দকার রাজা মাস্টার, সহকারী অধ্যাপক চাঁদ আলী, সাবেক পুলিশ সুপার আবুল বাশার মোল্লা, অ্যাড. রবকুল হোসেন, উপজেলা সভাপতি জাহিদ হোসেন রেন্টু, এটিও নুরুল ইসলাম, ব্যাংকার লিয়াকত আলী, সাবেক ব্যাংকার দীলিপ কুমার বিশ্বাস, শিক্ষানুরাগী ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু মুসা, সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইয়াকুব আলি মাস্টার, যুগ্মসম্পাদক কাজী রবিউল ইসলাম, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কাজী খালেদুর রহমান অরুণ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক আতিয়ার রহমান, আলম হোসেন, বিআরডিবি চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম মুহিদ, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদের নেতা সহকারী অধ্যাপক নাজমুল হক পানু, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ জকু, আব্দুল হালিম, অ্যাড. আব্দুল মালেক, উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আহসান উল্লাহ, কাউন্সিলর জহুরুল ইসলাম স্বপন, মতিয়ার রহমান ফারুক, জাহিদুল ইসলাম, আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি আশরাফুল হক প্রমুখ।
২য় পর্বে আলোচনানুষ্ঠান ও প্রাক্তন ছাত্রদের পরিবারের সদস্যদের খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন আলমডাঙ্গা পৌরসভার নব নির্বাচিত মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসান কাদির গনু। সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দর্শক মাতিয়েছে আলমডাঙ্গা কলাকেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া এই প্রাণের উৎসব সফল করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য শেখ আব্দুল জব্বার, হামিদুল ইসলাম আজম, ঢাকায় অবস্থানকারীদের মধ্যে ব্যাংকার লিয়াকত আলী, ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, নাট্য ব্যক্তিত্ব তৌহিদুল ইসলাম, সাংবাদিক এনামুল হক প্রমুখ। সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন রিপন বেগ, বিপ্লব, মহাসিন আলী, মোমিন, বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
টানা ২ দিনব্যাপী অর্থাৎ আজ শনিবারও চলবে এ উত্তুঙ্গ আনন্দ যাপনের ফল্গুধারা। শুধু বিদ্যালয় নয়, আনন্দে মাতোয়ারা আলমডাঙ্গাবাসী। প্রাণের উৎসবের আমেজ এখন আলমডাঙ্গার আকাশে-বাতাসে। এ উৎসবকে ঘিরে আলমডাঙ্গা শহর এখন রীতিমতো উৎসবের শহরে পরিণত হয়েছে। আলমডাঙ্গা অঞ্চলের সর্বাধিক পুরোনো এ ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ প্রজন্মের পর প্রজন্মব্যাপী শিক্ষার দেয়ালি জ্বালিয়েছে ঘরে ঘরে, হৃদয়ে হৃদয়ে। এখনও এলাকার সবচেয়ে বড় প্রজ্ঞালোকদীপ্ত বাতিঘর হিসেবে পরিগণিত। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী যারা এখন দেশে-বিদেশে প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার দ্যূতি ছড়িয়ে বিখ্যাত হয়েছেন, তারা এখন প্রায় সকলে প্রাণের উৎসবে যোগ দিতে ছুটে এসেছেন আলমডাঙ্গায় শেকড়ের টানে। আলমডাঙ্গার বাইরে অবস্থানকারীরা বহুদিন পর নিজ শহরে ফিরে নিজ নিজ ব্যাচের বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে বের করছেন। যেন সকলের অন্তরে বসে কেউ গেয়ে চলেছে ‘আবার দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয়।’ সকলে মিলে কোলাহল করছেন। মাত্র ২ দিনের জন্য ফিরিয়ে আনতে ব্যস্ত স্বর্ণালী শৈশব।
উল্লেখ্য, প্রায় শতাধিক বছর পূর্বে আলমডাঙ্গা মফস্বলের গোড়াপত্তন। আলমডাঙ্গা অঞ্চলে রেললাইন স্থাপনকে কেন্দ্র করে শহরের পুরাতন মোকামে (বর্তমানে রথতলা) এতদাঞ্চলের সবচে বড়বাজার বসে। আলমডাঙ্গা রেলস্টেশন কেন্দ্রিক পুরাতন মোকামের দ্রুত বর্ধনশীল ব্যবসার আকর্ষণে আশপাশের এলাকা থেকে ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ছুটে আসেন। মাত্র কয়েক বছরেই আলমডাঙ্গা ব্যবসাসফল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠে। এর অব্যবহিত পরই নব্য এলিট শ্রেণির ব্যবসায়ীদের চাহিদার প্রেক্ষিতে ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এ ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ। কুষ্টিয়া মিরপুরের আমলার তৎকালীন জমিদার নীল মাধব সাহা ও ব্রজেন্দ্রনাথ সাহা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেন। বিদ্যালয়টি এরপর থেকে আজোবধি শতাধিক বছর ধরে এতদাঞ্চলে জ্ঞানের বাতিঘর হিসেবে দ্যূতি ছড়িয়ে আসছে। বিদ্যালয়টি বর্তমানে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। শহরেই এটিম ও বি টিম নামে বিদ্যালয়ের নিজস্ব দুটি খেলার মাঠ রয়েছে। এছাড়াও শহীদ মিনার মাঠ রয়েছে। কয়েক শ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় সোয়া ৯ একর জমি রয়েছে। এ বিদ্যালয়ের ছাত্র পরবর্তীকালে শিক্ষক মরহুম শহীদুল্লাহ ওল্টু ছিলেন ভাষা সৈনিক। অনেক শিক্ষার্থী মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত জমিদার এসকে সরকার। তিনি ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়টির কিংবদন্তীতুল্য প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত আব্দুল জব্বার। এই অমিত প্রতিভাধর ব্যক্তি ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৭২ সাল অবধি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত হন। ভূষিত করা হয় স্বর্ণপদকে। তার সময়কে এ বিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ আখ্যায়িত করা হয়। এতদাঞ্চলের সবচে বৃহৎ ও প্রাচীন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরনের দাবি ক্রমশ উচ্চকিত হচ্ছে।