মাথাভাঙ্গা মনিটর: ফের রক্তাক্ত হলো পাকিস্তানের শিক্ষাঙ্গন। ফের বন্দুকের উপর্যুপরি গুলিতে প্রাণ হারালো ছাত্র ও শিক্ষকরা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এক স্কুলে হামলা করে ১৩৪ ছাত্র-শিক্ষককে হত্যার পর এবার জঙ্গিরা রক্তাক্ত করলো দেশটির এক বিশ্ববিদ্যালয়। গতকাল বুধবার এই হামলায় প্রাণ গেলো দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের চারসাড্ডা জেলার বাচা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ ২৫ জনের। এদের মধ্যে অন্তত একজন অধ্যাপক আছেন। আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশত শিক্ষার্থী। পার্লামেন্টে এক এমপি এ তথ্য জানিয়েছেন। পুলিশ বলছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত চারজন ছিলো হামলাকারী। তিন ঘণ্টাব্যাপী বন্দুকযুদ্ধ চলার পর পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিশেষ বাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পাকিস্তানের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান প্রথমে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করলেও পরে অস্বীকার করে।
পাকিস্তানের স্থানীয় সময় সকাল প্রায় ৯টা। পেশোয়ারের বাচা খান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জড়ো হচ্ছে ছাত্ররা। শিক্ষকেরাও হাজির হচ্ছেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল ছিলো পশতুন স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী খান আবদুল গাফফার খানের মৃত্যুবার্ষিকী। তার নামেই বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয়। সেই উপলক্ষেই আয়োজন করা হয়েছিলো এক স্মরণ অনুষ্ঠানের। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই কবিতা অনুষ্ঠান ‘মুশাইরা’ শুরু হওয়ার কথা। এই অনুষ্ঠানে ৬০০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হঠাৎ গুলির শব্দ। ছাত্র-শিক্ষকদের লক্ষ্য করে ছুটে আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। তার মাঝে বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে গোটা এলাকা। হাজার তিনেক ছাত্র ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তবে তাদের বেশিরভাগেরই ছুটি ছিলো। ক্লাস না থাকায় সেই সময় হোস্টেলে ছিলো অনেকেই। জঙ্গিরা মূলত সেখানেই হামলা চালায়।
নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমেই তারা কয়েকটি বিকট বিস্ফোরণ ঘটায়। আতঙ্কিত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা পরীক্ষার হল এবং টয়লেটে আশ্রয় নেয়। পুলিশ ধারণা করছে, ক্যাম্পাসের পেছন দিকে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গেষ্টহাউজ অবস্থিত তার দেয়াল বেয়ে হামলাকারীরা এসেছে। সম্ভবত চারজন বন্দুকধারী ছিলো। তবে গোয়েন্দা সূত্র বলছে, হামলাকারী ছিলো আট থেকে দশজন। তারা কুয়াশার মধ্যে কালো কাপড় পরে আসে। এই সময় তারা গুলি করতে করতে আসে। কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যায়। তারা ক্লাস কক্ষ এবং হোস্টেলে শিক্ষক ও ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়।
পেশোয়ারে স্কুলে হামলার মূল হোতা এবং টিটিপি’র গিডার গ্রুপের নেতা উমর মানসুর ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে জানান, চারজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালানোর জন্য পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মোহাম্মদ খোরাসানি এক বিবৃতিতে জানান, এই হামলা তারা চালাননি। বিবৃতিতে তিনি এই হামলার নিন্দা জানান এবং শরিয়াহ বিরোধী বলে মন্তব্য করেন। তিনি সতর্ক করে দেন, যারা এই হামলায় টিটিপি’র নাম ব্যবহার করছেন তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, অন্তত আট থেকে দশজন সন্ত্রাসী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলো। তাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর হবে। তারা বেসামরিক পোশাকে এসেছিলো এবং তাদের মুখ ছিলো ঢাকা। হামলার খবর পেয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এসে ভিড় করে একং কান্নাকাটি শুরু করেন। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ডির, হঙ্গু এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের অন্যান্য এলাকার।
প্রদেশের মন্ত্রী শাহ ফারমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৪ জন নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। পরীক্ষার হলে ২০০ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলো। তাদের নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়। আঞ্চলিক পুলিশ প্রধান সাঈদ ওয়াজির বলেন, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মারা গেছেন গুলিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ছাত্র হোস্টেলেও হামলা চালানো হয়। চারসাড্ডা জেলা হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ১৮ জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পেরেছেন। পাকিস্তান তেহরিক-ই-তেনসাফের (পিটিআই) প্রদেশের মুখপাত্র শওকত ইউসুফজাই জানিয়েছেন, ৫০ থেকে ৬০ জন হামলায় আহত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী এক ছাত্র জানিয়েছে, হামলাকারীরা তাদেরই মতো হবে। তবে, বয়স প্রায় এক হলেও তাদের পরনে ছিলো সেনার পোশাক। আর সকলের হাতেই ছিলো একে-৪৭। তিনি জানান, আমাদের ক্লাস ছিলো না বলে, হোস্টেলের ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ গুলির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। পুলিশ সূত্রে খবর, সকালে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে পড়ে অন্তত ১০ জন জঙ্গি। খবর পেয়ে নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছায়। শুরু হয় গুলির লড়াই। হামলা শুরুর প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ডিজি অসীম বাজওয়া টুইট করে জানান, সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে সেনা জওয়ানরা। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই তারা বুঝতে পারেন, জঙ্গিরা দুইটি ভাগে ভাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে হামলা চালাচ্ছে। সেই মতো পরিকল্পনা করা হয়। নামানো হয় কমান্ডো বাহিনী। সেনারা প্রথমে দুই জঙ্গিকে হত্যা করেন। কিছু সময় পরে ডিজি আরো দুই জঙ্গিকে হত্যার খবর দেন। ছাদে তখনও দুই জঙ্গি লুকিয়ে থাকার আশঙ্কার কথা জানান তিনি। এরপরে বেলা একটা নাগাদ জানানো হয়, মোট চার জঙ্গিকে হত্যা করে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল নিয়েছে সেনাবাহিনী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র জানায়, গুলির আওয়াজ শুনে আমরা পালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, রসায়নের শিক্ষক আমাদের ভেতরে ঢুকতে বলেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই তার মাথায় গুলি লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন স্যার। এরপর ঘরে ঢুকে আমরা পেছনের দেয়াল টপকে পালাই। হোস্টেলের অন্য এক ছাত্র জানায়, জঙ্গি-সেনার লড়াইয়ের সময়টা আমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম। সবকিছু শেষ হওয়ার পর সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধার করে।