মাজেদুল হক মানিক/কামরুজ্জামান বেল্টু: একটি গাছে এক রাতে কতোটুকু রস হয়? স্থানভেদে গাছের চেহারাতেও যেমন থাকে পার্থক্য, তেমনই রসও দেয় একেক গাছে একেক রকম। তবে জিড়েন গাছে গড়ে অর্ধেক ভাড়তো হয়ই। কতোটুকু রসে কতোটুকু গুড় হয়? আগে যেটুকুই হোক, এখন গুড়ের পরিমাণ অনেকটা ইচ্ছেমতোই করা যায়। কেমন? খেজুরগাছের রসের সাথে চিনির মিশ্রণে গুড়ের পরিমাণ যেমন বেড়ে হচ্ছে দ্বিগুনের বেশি, তেমনই ফিটকিরির ব্যবহারে গুড়ও হয়ে যাচ্ছে মেমসাহেবের গায়ের রং। এসবে খেজুরগুড়ের সেই প্রকৃত স্বাদ যেমন থাকছে না, তেমনই স্বাস্থ্যের জন্য হচ্ছে হুমকির কারণ।
খেজুরগুড়ের জন্য দেশের অন্যতম বৃহৎ হাট চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের সরোজগঞ্জ। এ হাট থেকে প্রায় প্রতি হাটের দিনই ৭/৮ ট্রাক খেজুরগুড় দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি হয়। বিদেশেও যায়। তবে দিন দিন খেজুরগুড়ের স্বাদ ও গন্ধ অনেকটাই ফিকে হয়ে যাওয়ায় তাতে আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকে। আর রস? নিপা ভাইরাসের ভয়ে ওদিকে তাকানোর সাহস হারিয়েছে কয়েক বছর ধরে। এরপরও শীতের সকালে বা সাঝে খেজুরের এক গ্লাস মিষ্টি রস কে না চায়? রসে ভাড়ে কেউ চুমক দিক আর না দিক, রস জ্বালিয়ে গুড় হয়। সেই গুড়ের পায়েশ? তুলনাহীন। আর তাতরসের ক্ষীর? বিশ্ব বিখ্যাত। যে একবার খেয়েছেন, শীত এলে তিনি আবারও তার স্বাদ নেয়ার জন্য প্রহর গুণতে থাকেন। এসব তো বৃহত্তর যশোরের চিরচেনা ছবি। চুয়াডাঙ্গারও। মেহেরপুরের? খেজুরগাছ কেটে রস খাওয়ার বিষয়টি একসময় শখের বিষয় থাকলেও কালক্রমে তা বাণিজ্যিকেও রূপ নিয়েছে। কেমন? যেমন নবাব আলী ও তার ছয় সহযোগী রাজশাহী থেকে এসেছেন মেহেরপুরের জুগিরগোফা গ্রামে। এ গ্রামের এলবার্টকে কে না চেনে? অনেকগুলো পুকুর। মাছের বিশাল খামার। এরই মাঝে রয়েছে অনেকগুলো খেঁজুরগাছ। রাজশাহী থেকে এই খামারের খেজুরগাছ কেটে রস নিয়ে গুড় উৎপাদনের জন্যই রাজশাহীর ৪ জন অবস্থান করছেন এখানে। রাজশাহী থেকে আসা গাছি নবাব আলী জানান, গত বছর গাংনী এলাকা থেকে তাদের ভালো লাভ হয়েছিলো। তাই এবারো কার্তিকের শেষ দিকে তারা জুগিরগোফা গ্রামে এসেছেন। এলবার্ট মিয়ার বাগানসহ আশপাশের প্রায় ৪শ’ খেজুরগাছ থেকে রস আহরণের জন্য গাছ মালিকদের কাছ থেকে ঠিকা নিয়েছেন তারা। পালাক্রমে সপ্তাহের প্রতিদিন এসব খেজুরগাছ ছিলে রস আহরণ করেন। দুপুর হলেই গাছিরা বেরিয়ে পড়েন খেজুর বাগানে। গাছের মাথার দিকে ছিলে ঠিলে বেঁধে রাখেন। সারারাত ওই ঠিলেয় রস জমা হতে থাকে। তারপর ভোরে তা সংগ্রহ করেন গাছিরা। আহরিত রস একটি পাত্রে দীর্ঘক্ষণ জ্বালিয়ে প্রস্তুত করেন গুড় ও পাটালি।
গাছিরা জানান, এলাকার মানুষের বাড়ির আঙিনাসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক খেজুরগাছ রয়েছে। এগুলো থেকে তারা রস আহরণ করেন। এর বিনিময়ে খেজুরগাছ মালিকদের গাছপ্রতি কিছু টাকা কিংবা গুড় দেয়া হয়। প্রতিদিন তারা প্রায় এক মণ গুড়-পাটালি উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন বলে জানান গাছী নবাব। তিনি অবশ্য খেজুর গুড়ে চিনি দিচ্ছেন না বলেই দাবি করেছেন।
গাংনী বাজারের গুড় ব্যবসায়ী জসিম উদ্দীন জানান, প্রতিদিন তিনি জুগিরগোফা গ্রামের গাছিদের কাছ থেকে গুড় কিনে জেলার বিভিন্ন হাটে বিক্রি করেন। অন্য জেলার গুড়ের চেয়ে এখানকার গুড় ভেজালমুক্ত ও সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এর চাহিদা ব্যাপক। প্রতি কেজি গুড়ের পাইকারি দাম ৭০ ও খুচরা ৮০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে স্পেশাল গুড়-পাটালির দাম আরো বেশি। ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী গুড়-পাটালি সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে।
হিজলবাড়িয়া গ্রামের গাছি ইকরামুল হক জানান, তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে গাছির কাজ করছেন। শরীরে এখন আর আগের মতো জোর না থাকলেও পেশা ও নেশার টানে এখনো তিনি খেজুরগাছ ছিলে রস আহরণ করেন। প্রতিদিন ৫-১০ কেজি গুড় তৈরি করে তা বিক্রি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। মেহেরপুর জেলার প্রতিটি গ্রামেই দেখা মেলে খেজুরগাছের। রস আহরণ প্রক্রিয়া কষ্টসাধ্য হওয়ায় আজকাল অনেক গাছিই এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তবু এখনো স্বল্প পরিসরে হলেও রস আহরণ ও গুড় তৈরি চোখে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে অনেকেই স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন গুড়-পাটালি। এ গুড় দিয়েই ঐতিহ্যবাহী খেজুর রসের পিঠা-পুলি তৈরি হয় ঘরে ঘরে।
এদিকে চুয়াডাঙ্গার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে খেঁজুরগাছের রস জালিয়ে গুড় তৈরির ব্যবস্থা। সম্প্রতি কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে অধিকাংশ গাছির গৃহিণীই রস জ্বালিয়ে মেশাচ্ছেন চিনি।