সর্বক্ষেত্রেই দরকার পুলিশের সময়োপযোগী বিচক্ষণতা

এনামুলের বয়স আর কতোই হয়েছিলো, টেনেটুনে তিন সাড়ে তিন। অতোটুকু অবুঝ শিশুকে যে বা যারাই ব্লেড দিয়ে কেটে হত্যা করুক, তার বা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অনিবার্য। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি মানে এমন শাস্তি, যা দেখে সমাজের কেউ কোনো শিশুকে হত্যা করা দূরের কথা তেমন অমানুষ হওয়ার বিষয়টি ভাবতেই সাহস পাবে না। আইন, আইনে কঠোর শাস্তি মূলত সে কারণেই। আইন যেমন অপরাধীকে অপরাধের মাত্রা বুঝে উপযুক্ত শাস্তির নির্দেশ করে, তেমনই একটি অন্যায়ের প্রতিবাদের নামে আর একটি অন্যায়কেও প্রশ্রয় দেয় না। ষড়যন্ত্র, মিথ্যা অভিযোগ তুলে নির্যাতন? এসবও দেশের প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিমূলক অপরাধ। বিষয়টি মনে রাখতে হবে চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার পল্লি বানিনাথপুর গ্রামবাসীর। সকলকেই বুঝতে হবে, বোঝাতে হবে, কোনটি অন্যায়, কোনটি ন্যায়। পুলিশকেও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সকলকে বোঝাতে হবে অন্যায় চলবে না। যে যতো বড়ই হোক, অন্যায় করলে পার পাওয়া যায় না তা নিশ্চিত করতে না পারলে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ে। বাড়ে পেশীশক্তি প্রয়োগ। বানিনাথপুরে একের পর এক ঘটনার জন্য পুলিশের সময়োপযোগী বিচক্ষণতায় যে ঘাটতি তা বলাই বাহুল্য।
আলমডাঙ্গার জামজামি ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বার মধুপুর বানিনাথপুরের নূর ইসলাম। তার তিন সাড়ে তিন বছরের শিশুসন্তান গত ২০ নভেম্বর বিকেলে নিখোঁজ হয়। খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে রাত ৮টার দিকে বাড়ির অদূরবর্তী পানবরজের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় রক্তাক্ত মৃতদেহ। পাশেই পড়েছিলো কিছু ফুল ও একটি রক্তমাখা ব্লেড। অনেকেরই অনুমান, ফুল দেয়ার কথা বলে শিশু এনামুলকে ডেকে নিয়ে পানবরজে খুন করা হয়েছে। কেন খুন? শিশু এনামুলের পিতার অভিযোগ পুর্ব বিরোধের জের ধরে গ্রামেরই নায়েবসহ তার শ্বশুর ফজলুর রহমান, ফজলুর ছেলে রেজাউলসহ কয়েকজন হত্যা করেছে। পুলিশ রেজাউল, নায়েব ও ফজলুকে ওই রাতেই গ্রেফতার করে। রিমান্ডেও নেয়। অবশ্য হত্যার বিষয়ে গ্রেফতারকৃতদের মুখ থেকে যেমন স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি, তেমনই ওরাই যে হত্যা করেছে তাও গত ৫২ দিনে নিশ্চিত করতে পারেনি। শুধু রেজাউলই নয়, তার স্ত্রী রেহেনা খাতুন, ছেলে আল আমিন ও নায়েব আলীর স্ত্রী ফরিদা খাতুনকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযুক্ত হওয়া মানে যেমন অপরাধী নয়, তেমনই গ্রেফতার হলেই তাকে খুনী বলার কোনো কারণ নেই। বিধি অনুযায়ী তদন্তাধীন মামলার কোনো আসামিকে অপরাধী বলা দূরাস্ত, তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেয়ার পরও তা বলা যায় না, যতোক্ষণ না, আদালত কর্তৃক অপরাধী প্রমাণিত হচ্ছে। সেমতে গ্রেফতারকৃতদের কাউকে এখনই খুনির দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ নয়। যতোই আসামির বাড়ি থেকে রক্তমাখা লুঙ্গি বা পোশাক উদ্ধার হোক, আর গর্তই খুঁজে পাওয়া যাক। তা হলে ঘরবাড়ি ভাঙচুর কেন? শিশু হত্যার বিষয়টি স্পর্শকাতর হেতু, আসামিদের বিরুদ্ধে ফুঁসেছে গ্রামের অনেকে। অভিযুক্তদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগসহ লুটপাট হয়েছে। সর্বশেষ গ্রেফতারকৃত দু আসামির দু পিতাকে ধরে পিটুনির পর পুলিশে দেয়া হয়েছে। এ সময় অভিযোগ করে বলা হয়েছে, শিশু এনামুল হত্যা মামলার দু আসামির দু পিতা কয়েকজনকে সাথে নিয়ে শিশু এনামুলের পিতাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। এ কারণে গ্রামবাসী দু বৃদ্ধকে ধরে পুলিশে দিয়েছে। তাদের নিকট থেকে ধারালো দুটি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে দু বৃদ্ধ অবশ্য অভিযাগ অস্বীকার করে বলেছেন, আমরা অসুস্থ আত্মীয়কে দেখে ফেরার পথে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি।’ অবশ্যই একটি হত্যা মামলার বাদীকে মারতে আসা অনেক বড় অন্যায়, আবার বানোয়াট অভিযোগ তুলে কাউকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয়াও অপরাধ। এক শিশু হত্যার পর আসামির বাড়ি ভাঙচুর, দু আসামির দু পিতাকে ধরে পিটুনি কি প্রমাণ করে না, যে পুলিশের কর্তব্যপরায়ণতায় ঢিলেমি আছে! কেননা, কারো বাড়ি ভাঙচুর বা পিটুনির এখতিয়ার আমাদের দেশের প্রচলিত আইন কাউকে দেয়নি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন, তাহলে আইন রক্ষকরা কী করছেন?
যে সমাজে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চক্রান্ত ষড়যন্ত্র অনেক ভয়ানক, বর্ণনা শুনলেই শিউরে ওঠে গা, সেই সমাজে কোনো পক্ষের কোনো উক্তি কতোটুকু বিশ্বাসযোগ্য তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা তথা তদন্তের দাবি রাখে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অংগ্নিসংযোগ গণপিটুনির ঘটনা শুধু আবেগতাড়িত নয়, আড়ালে হুচুকই হোক আর চক্রান্ত ষড়যন্ত্রই হোক সুপ্তভাবে যে মতলববাজেরই স্বার্থ হাসিল করে তা উপলব্ধিতে আসে পারে। শিশু এনামুল হত্যা মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয়েছে তাদের স্ত্রীরাও না হয় আসামির তালিকায় গেলো, উপযুক্ত সন্তানও। বাড়ির বৃদ্ধ ও শিশুরা? তাদের আশ্রয়টুকু কেড়ে নেয়ার অপরাধ কম কিসের? ভাঙচুর লুটপাটের আগে আবেগতাড়িতরা একটু ভেবে দেখলে নিশ্চয় অতোবড় অন্যায় উল্লাসে মেতে উঠতে পারতো না। তাছাড়া পুলিশ সর্বক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করলে কোনো ক্ষেত্রেই আবেগ অতোটা উম্মাদনায় মত্ত হতে দেয় না। একটি অন্যায় মেনে নেয়া বা নমনীয় দৃষ্টিতে দেখা মানেই সমাজে অন্যায় প্রবণতাকে সংক্রমিত হতে উৎসাহিত করা। রুখতে হবে।