মা ছেলের নির্যাতনে জখম বাগানমালিকের মৃত্যু : ক্ষোভ

গাংনী প্রতিনিধি: প্রায় ৪৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জালড়ে হেরে গেলেন কৃষক চাঁন্দ আলী। অবুঝ দু কন্যা সন্তান ও স্ত্রীসহ স্বজনদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। গত মঙ্গলবার দুপুরে নিজের আমবাগানের ডাল কাটতে বাধা দেয়ায় শ্যামল নামের এক যুবকের হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। রাজশাহীর একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি মারা যান।
নিহত চাঁন্দ আলী (৩০) মেহেরপুর গাংনী উপজেলার হাড়াভাঙ্গা গ্রামের বাগানপাড়ার হোসেন সরকারের ছেলে। তার মৃত্যুতে এলাকায় গভীর শোকের পাশাপাশি হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি জোরালো হচ্ছে। ঘটনার পর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছে হামলাকারী একই গ্রামের মকবুল হোসেনের স্ত্রী আসমানী খাতুন ও তার ছেলে শ্যামল হোসেনসহ পরিবারের সদস্যরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার দুপুরে নিহত চাঁন্দ আলীর আম বাগানে আমগাছের ডাল চুরি করে কাটছিলো শ্যামল হোসেন। বিষয়টি টের পেয়ে তাতে বাধা দেয় চাঁন্দ আলী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শ্যামল ও তার মা আসমানী খাতুন চাঁন্দ আলীকে আমগাছের ডাল দিয়ে মারপিট করে। মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন চাঁন্দ আলী। পরে পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাতেই রাজশাহী নেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। পরিবারের পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার দিনগত রাতেই রাজশাহীর একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানেও তার শারীরিক অবস্থা আরো অবনতি হলে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) নিবিড় পরিচর্যায় রাখা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবরে পরিবার ও স্বজনদের পাশাপাশি এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। গ্রামে বখাটে হিসেবে পরিচিত শ্যামল ও তার মায়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ওঠে জোরেশোরে। নিহতের লাশ রাজশাহীতে ময়নাতদন্ত শেষে রাত ৮টার দিকে বাড়িতে পৌঁছায়। রাত ৯টায় বাড়ির পাশে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।
নিহতের মা রোজিফা খাতুনসহ পরিবারের লোকজন জানান, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে শ্যামল ডানপিঠে হিসেবে পরিচিত। মানুষকে মারধর, ছোটখাটো চুরি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত সে। গোষ্ঠির প্রভাব-প্রতাপের কারণে শ্যামলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউই প্রতিবাদ করতে পারে না। ওই গোষ্ঠির লোকজন ছাড়া পাড়ার কেউ কোন কথাও বলতে পারে না। তাদের অন্যায়-অত্যাচার মুখ বুজেই সহ্য করতে হয়। একারণে শ্যামল ডানপিঠে থেকে হয়ে ওঠে খুনি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রোজিফা খাতুন কান্নায় মুর্ছা যাচ্ছিলেন। বুকের ধন বুকে ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি ছিলো বারবার। তার মতো আর কারো মায়ের যেন বুক খালি না হয় এমন বিপাল করতে করতে তিনি মুর্ছা যাচ্ছিলেন।
নিহতের পরিবারিক সূত্রে আরো জানা গেছে, শ্যামলদের বাড়ি থেকে চাঁন্দ আলীর বাড়ির দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার। শ্যামলদের বাড়ির কাছে রয়েছে চাঁন্দ আলীর পিতার আম ও বাঁশ বাগান। ওই বাগান থেকে প্রায়ই ডালপালা ও বাঁশ জোরপূর্বক কেটে নিতো শ্যামল ও তার পরিবার। এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে মাঝেমধ্যেই দ্বন্দ সৃষ্টি হয়ে আসছিলো। চাঁন্দ আলীর পিতার ক্ষেতের বিভিন্ন ফসল চুরি করত শ্যামল। এসব অত্যাচার দীর্ঘদিন থেকে চলতে থাকলেও শ্যামলদের গোষ্টির প্রভাবে কোন প্রতিকার ছিল না চাঁন্দ আলীর পরিবারের কাছে। তাই মুখ বুজেই তারা এসব মেনে নিয়ে বসবাস করছিলেন। মঙ্গলবার আমগাছে ডাল কাটার সময় হাতেনাতে শ্যামলকে ধরে ফেলে চাঁন্দ আলী। ওই সময় তিনি মাঠে মসুরি ক্ষেতে বিষ স্প্রে করতে যাচ্ছিলেন। অন্যায় ধরা পড়লেও শ্যামলের স্বভাব-সুলভ আচরণ দিয়ে চাঁন্দ আলীকে ঘায়েল করার অপচেষ্টা শুরু হয়। এক পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে বাক বিতণ্ডা শুরু হয়। শ্যামলের মা ও শ্যামল দুজনে মিলে চাঁন্দ আলীর ওপর হামলা চালায়। নিরুপায় চাঁন্দ আলী জীবন বাঁচাতে বাগানের পাশ্ববর্তী তার ফুফু রহিমা খাতুনের বাড়ির মধ্যে আশ্রয় নেয়। রহিমার বাড়ির উঠানেই আমগাছের ডাল দিয়ে চাঁন্দ আলীর মাথাসহ শরীরে এলোপাথাড়ি আঘাত করে শ্যামল। গুরুতর আঘাতের সাথে রক্তক্ষরণ হলে অনেকটাই নিথর হয়ে পড়ে চাঁন্দ আলী। সে মারা গেছে ভেবে পালিয়ে যায় শ্যামল ও তার মা।
এদিকে চাঁন্দ আলীর চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকা পরিবারের পক্ষ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার গাংনী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে আসামিদের গ্রেফতারে স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ। আসামি গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলে জানান গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকরাম হোসেন। তিনি আরো জানান, হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। যেহেতু চাঁন্দ আলী নিহত হয়েছেন তাই ওই মামলার সাথে হত্যা মামলার ধারা যুক্ত হবে।
নিহতের পারিবারিক পরিচয়: হাড়ভাঙ্গা গ্রামের বাগানপাড়ার কৃষক হোসেন সরকারের তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে নিহত চাঁন্দ আলী বড়। মেজ ছেলে ফিরোজ কৃষিকাজ এবং ছোট ছেলে সুরুজ আলী এসএসসি পরীক্ষার্থী। মেয়ে রঞ্জনা, লিপি ও কাজলী বিবাহিতা। বছর আটেক আগে এ উপজেলার পীরতলা গ্রামের শফিকুল ইসলামের মেয়ে শরিফা খাতুনকে বিয়ে করেন চাঁন্দ আলী। পিতা বয়োবৃদ্ধ তাই নিজেই ধরেছিলেন সংসারের হাল। দাম্পত্য জীবনে তিনি দুই মেয়ে সন্তানের জনক। এদের মধ্যে সানজিদা খাতুন (৪) ও ছোট মেয়ে সুমা খাতুনের বয়স দুই বছর। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় স্ত্রী ছিলেন চাঁন্দ আলীর সাথে। মেয়ে দুটি রয়েছে বাড়িতে দাদির কাছে। গতকাল দুপুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আত্মীয় স্বজনরা বাড়িতে ভিড় করে। কান্নার রোল পড়ে সারা বাড়ি জুড়ে।

Leave a comment