মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আপিলের রায় : নিজামীর ফাঁসি বহাল

স্টাফ রিপোর্টার: ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও উসকানি প্রদানসহ মানবতাবিরোধী ৩টি অপরাধে দোষী জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর আগে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ নিজামীকে চারটি অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। নিজামী এখন এই রায়ের বিরুদ্ধে (রায় প্রকাশের) ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন দাখিল করতে পারবেন। যদিও আপিল বিভাগে এখন পর্যন্ত কোনো রিভিউ আবেদন গৃহীত হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনালের এই রায় বাতিল চেয়ে তাকে বেকসুর খালাস দেয়ার আবেদন জানিয়ে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর আপিল করেন নিজামী। এগার দিন শুনানির পর গতকাল বুধবার আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। সকাল ৯টা ৪ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এজলাসে আসেন। এ সময় এজলাশ কক্ষে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। সকাল ৯টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি রায় ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হলো।’
এদিকে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখায় অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় নিজামীর পরিকল্পনা ও ভূমিকা এই রায়ের মধ্য দিয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত হলো। সমগ্র জাতি ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা এই রায়ে স্বস্তি অনুভব করবে। অন্যদিকে নিজামীর প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন দাবি করেছেন, এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়নি। নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী বা কাউকে হত্যার সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছিলো না। সাজানো সাক্ষ্য দিয়ে এই দণ্ড দেয়া হয়েছে।
যে তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল: নিজামীর বিরুদ্ধে আনীত ২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের নিয়ে একটি সভা করেন নিজামী। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে ১৪ মে দুটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪শ জনকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। এছাড়া প্রায় ৩০-৪০ নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা। ছয় নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ নভেম্বর ধুলাউড়া গ্রামে ৩০ জনকে হত্যায় নেতৃত্ব ও সম্পৃক্ততা রয়েছে নিজামীর।
১৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নৃশংসতা চলাকালে মতিউর রহমান নিজামী ইসলামী ছাত্রসংঘ ও স্বাধীনতা বিরোধী সহযোগী বাহিনী আল বদরের সভাপতি ছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় আল বদর সদস্যদের সহযোগিতা, অনুমোদন, নৈতিক সমর্থন ও কর্মের বিষয়ে নিজামী সম্পূর্ণরূপে সচেতন ছিলেন। আল বদর সদস্যদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত না করায় তাদের অপরাধের দায় কোনোভাবেই নিজামী অস্বীকার করতে পারেন না। এই তিনটি অভিযোগে নিজামীকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
যেসব অভিযোগ থেকে খালাস: চার নম্বর অভিযোগ হলো, পাবনার করমজা গ্রামে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটের ঘটনায় নিজামীর সম্পৃক্ততা। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের দণ্ড বাতিল করে তাকে খালাস দিয়েছে।
প্রথম অভিযোগ হলো: ১৯৭১ সালের ৪ জুন পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে অপহরণ করে হত্যা। তৃতীয় অভিযোগ হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিজামী যাতায়াত করতেন এবং হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণে সহযোগিতা করতেন। এই দুটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলো। তবে আপিল বিভাগ অভিযোগ দুটি থেকে নিজামীকে খালাস দিয়েছে।
দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন বহাল: নিজামীর বিরুদ্ধে সপ্তম অভিযোগ হলো, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তার দেয়া তথ্য অনুসারে বৃশালিকা গ্রামের সোহরাব আলীকে তার স্ত্রী-পুত্রের সামনে পাকিস্তানি সেনারা আটক ও হত্যা করে। অষ্টম অভিযোগ হলো, একাত্তরের ৩০ আগস্ট নিজামী রাজধানীর নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেলে আটক গেরিলাযোদ্ধা রুমী (জাহানারা ইমামের ছেলে), বদি, জালাল, জুয়েল ও আজাদকে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন। এই দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নিজামীকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দায়ের করা ছয়টি আপিলের ওপর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের শীর্ষ নেতা আলী আহসান মো. মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা ও এম কামারুজ্জামান এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় ইতোমধ্যে কার্যকর করেছে সরকার। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিলে তার সাজা পরিবর্তন করে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং নিজামীর আপিল আংশিক মঞ্জুর করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় মারা গেছেন জামায়াত নেতা গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম। পরে এসব আপিল অকার্যকর ঘোষণা করে আদালত।
নিরাপত্তা জোরদার: নিজামীর রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কোর্টের প্রতিটি প্রবেশ ফটকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি নজরদারি ছিলো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের।