জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের বৃহৎ একটি সামরিক ঘাঁটি খুঁজে বের করেছে গোয়েন্দা পুলিশ

স্টাফ রিপোর্টার: চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে হাটহাজারী থানার দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমানবাজার এলাকায় জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বৃহৎ একটি সামরিক ঘাঁটি খুঁজে বের করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গত শনিবার রাত ১২টা থেকে রোববার ভোর ৪টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও গোপন নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে ওই ঘাঁটি থেকে। এছাড়া নয়ন, রাসেল ও ফয়সাল নামের ৩ জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আস্তানাটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার ফারদিনের আস্তানা বলে নিশ্চিত হলেও তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার রাতে নগরীর কাজীর দেউড়ি, নালাপাড়া ও কসমোপলিটন এলাকা থেকে নয়ন, ফয়সালসহ ৩ জনকে আটক করা হয়। এদের তথ্যের ভিত্তিতে আমানবাজারের জয়নব কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে ইছহাক ম্যানশনের নিচতলায় ফারদিনের আস্তানা নিশ্চিত হওয়ার পর রাত ১২টার দিকে নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে সেখানে অভিযান শুরু হয়। অভিযানের শুরুতে বাড়িটি ঘিরে চারপাশে অবস্থান নেয় গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। পরে দেয়াল টপকে ও দরজা ভেঙে বাসার ভেতরে ঢুকে রাতভর অভিযান চালিয়ে একটি এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেল, ২৫০ রাউন্ড গুলি, দুই কেজি জেল এক্সপ্লোসিভ, ১০টি ডেটোনেটর, বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪টি পোশাক, নেমপ্লেট ও বেইজ ৱ্যাঙ্ক, সাংগঠনিক বিভিন্ন নথিপত্র ইত্যাদি পাওয়া যায়। এমনকি সরকারের অতি গোপন একটি নথিও ওই আস্তানায় পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, যে বাসার ভেতরে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া গেছে সেখানেই থাকতেন জেএমবির বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার ফারদিন। কিন্তু অভিযানের আগেই তিনি ওখান থেকে সটকে পড়েন। তবে রাসেলকে সেখানে পাওয়া যায়। অভিযান শেষে ভোর ৫টায় জেএমবি সদস্যদের ওই বাসা থেকে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নেয়া হয়। তবে দিনভর হাটহাজারী পুলিশ বাড়িটি পাহারায় রাখে। এদিকে গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধার হওয়া বিস্ফোরক দিয়ে দু-চারটি ভবন উড়িয়ে দেয়া সম্ভব। আস্তানায় যে এমকে-১১ রাইফেল উদ্ধার হয়েছে সেটি সাধারণ মানুষের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে আগে এ ধরনের কোনো অস্ত্র ব্যবহার হয়নি। এ অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু অবধারিত যা ১৫০০ গজ দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারবে। সাধারণত এটি সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বাবুল আক্তার জানান, গত ৫ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর থেকে আটককৃত ৫ জেএমবি সদস্য জিজ্ঞাসাবাদে সামরিক কমান্ডার ফারদিনের আস্তানা সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছিলো। এরপর অনুসন্ধানে নেমে আরো তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এই আস্তানার স্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হই। ৬ মাস ধরে এ আস্তানা গড়ে তুলেছিলো তারা। বাবুল আক্তার জানান, ৩ দিক থেকে বাড়ি ঘিরে ফেলার পর অনেক অনুরোধের পরও ভেতর থেকে কেউ গেট খুলে দেয়নি। পরে দেয়াল টপকে পুলিশের কয়েকজন সদস্য কমান্ডো স্টাইলে ভেতরে ঢুকে যান। তারা দ্রুত গেট খুলে দেয়ার পর নগর গোয়েন্দা পুলিশের অন্য সদস্যরাও ভেতরে ঢোকে। এরপর ফারদিনের বাসার দরজা খোলা নিয়ে শুরু হয় বিপত্তি। বারবার দরজা ধাক্কানোর পরও ভেতর থেকে কোনো ধরনের সাড়া না পেয়ে এক পর্যায়ে দরজা ভেঙে পুলিশ সদস্যরা ভেতরে ঢোকেন। বাবুল আক্তার বলেন, পুলিশের কাছে তথ্য ছিলো তা হচ্ছে ফারদিনের আস্তানা থেকে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিলো। আর কিছুদিন সময় পেলে তারা বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে সক্ষম হতো। এ অভিযানের মধ্যদিয়ে জেএমবির চট্টগ্রামে বড় ধরনের সহিংসতার পরিকল্পনা ঠেকানো গেল। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা জানান, যে পরিমাণ বিস্ফোরক সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে তা দিয়ে বিপুল পরিমাণ ককটেল-বোমা বানানো যেত।
গোপন নথি, মানচিত্র, সাংগঠনিক ছক: এই আস্তানা থেকে বেশকিছু গোপন ও স্পর্শকাতর নথিপত্র পেয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতর থেকে জারি করা একটি গোপন নির্দেশনাও আছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাও বিস্মিত। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে জঙ্গিদের বহনকারী পুলিশের একটি প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবির তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশ সদর দফতর থেকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে একটি গোপন চিঠি দেশের সকল ইউনিটে পাঠানো হয়। চিঠির বিষয়বস্তু এতোটাই স্পর্শকাতর যে ইউনিট প্রধান ছাড়া সেটি আর কারো কাছে থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই চিঠির অনুলিপি জেএমবির সামরিক কমান্ডারের আস্তানায় পেয়েছে পুলিশ।
এই অভিযান থেকে পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহূত ১৪টি পোশাক, নেমপ্লেট, বেইজ ৱ্যাঙ্ক, জেএমবি’র কাজের ছক সংক্রান্ত সাংগঠনিক মানচিত্র ও ডায়েরি পাওয়া গেছে। ডায়েরিতে সাঙ্কেতিক বিভিন্ন নির্দেশনা ও সঙ্কেত ছাড়াও কর্মকাণ্ডের বিবরণ রয়েছে। এছাড়া দাওয়াতী ও জিহাদি বিভিন্ন বইপত্রও উদ্ধার হয়েছে সেখান থেকে। উদ্ধার হওয়া মানচিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা।
গত ৫ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকায় জেএমবির আরও একটি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ হ্যান্ড গ্রেনেড ও বিস্ফোরকসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছিলো গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় নিজের ছোঁড়া গ্রেনেডে এক জেএমবি সদস্য সেখানে মারা যায়।
নাফিস নাম ব্যবহার করে ভাড়া নিয়ে মূলত ফারদিনই আমানবাজারের বাসাটিকে তার আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। এটি ছিলো এই জঙ্গিদের নাশকতার ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি। আর খোয়াজনগরে তিনি বিস্ফোরক মজুদ করেছিলেন।