মহাসিন আলী: পোলিও রোগ আর কালাজ্বর চলার গতি থামিয়ে দিলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাগ্য বিধাতা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে মেহেরপুরের বেশ কিছু শারীরিক প্রতিবন্ধীর। নিজে চলতে পারেন না। অথচ যাত্রী নিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেছেন আওয়াল (২২), সুস্তর আলী (৮৩) সহ মেহেরপুরের অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী। আর এ থেকে রোজগারের অর্থ দিয়ে চলছে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ। তাদের ভাগ্য খুলে দিয়ে স্বপ্ন পূরণে সাথী হয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত ৩ চাকার এ রিকশা। এ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশাই ভাত-কাপড় জোগাচ্ছে মেহেরপুরের শারীরিক প্রতিবন্ধী বিজন (৬৫) সহ আরো অনেক প্রতিবন্ধীর। কালাজ্বর আর পোলিও রোগ শিশুকালে পঙ্গু করে দিয়েছে আওয়াল, সুস্তর, বিজন, নাসিরসহ মেহেরপুরের অনেককেই। ক্র্যাচে ভর দিয়ে অথবা হুইল চেয়ারে বসে তাদের জরুরি প্রয়োজনীয় কাজটুকু তারা সারতে পেরেছেন মাত্র। কিন্তু রোজগার করতে না পারায় সব সময় অন্যের গলগ্রহ হয়ে থেকেছেন তারা। কিন্তু নিজেদের মতো করে তৈরি করে নেয়া ব্যাটারিচালিত ৩ চাকার রিকশা তাদের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। লেখাপাড়া থেমে নেই শারীরিক প্রতিবন্ধী আওয়ালের। তিনি এ বছর মেহেরপুর সরকারি কলেজের স্নাতক (দর্শন-সম্মান) শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি তার ব্যাটারিচালিত রিকশায় যাত্রী বহন করেন। এতে প্রতিদিন তার যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোর পরও সংসার চালাতে বাবার হাতে তুলে দেন বাকি টাকা। সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন প্রতিবন্ধী যুবক আওয়াল হোসেন। তিনি তার স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠে চলেছেন। লক্ষ্য পূরণ করেই তিনি খান্ত হবেন। এমন প্রত্যাশায় তার পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।
আওয়াল হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধী বলে পিতা-মাতার ঘাড়ে চেপে বসতে হবে এমন ছেলে নই আমি। সব সময় স্বাবলম্বি হওয়ার চেষ্টা করেছি। অবসর সময়ে নিজের বাসায় বসে বেশ কিছু ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়েছি। এ থেকে মাসে যে টাকা আসেছে তা দিয়ে শুধু আমার লেখা-পড়ার খরচ চলেছে। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত রিকশা পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন কলেজ করার পাশাপাশি অবসরে রিকশা চালিয়ে দিনে ৩/৪শ টাকা আয় করি। লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে বাবা-মার হাতে বাকি টাকা তুলে দেই। তিনি আরো বলেন, ব্যাংক ঋণ নিয়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বানিয়েছি। ঋণ শোধ হওয়ার পথে। এ রিকশা তার চলার গতি বাড়িয়েছে। আয়-রোজগারের পথ খুলে দিয়েছে।
মেহেরপুরের এ প্রাপ্ত থেকে ওই প্রান্তে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে ছুটে বেড়ান ৮৩ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী সুস্তর আলী। তিনি জানান, ঘোড়ায় গাড়ি চালিয়ে ও ব্যবসা বাণিজ্য করে ৯ সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছি। পরে নিজের একটি হস্তচালিত রিকশা নিয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলাচল করতেন। শেষ বয়সে স্ত্রী বিয়োগ হওয়ায় নতুন করে বিয়ে করায় সন্তানরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই তিনি তার হস্তচালিত রিকশাটি ব্যাটারি চালিত অটো রিকসা করে নিয়েছেন। বর্তমানে ব্যাটারি চালিত ৩ চাকার রিকসা চালান। এতে যে রোজগার হয় তা থেকে ঘর ভাড়া দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে খেয়ে পরে অনেক ভালো আছেন তিনি।
মেহেরপুর শহরের উপকন্ঠ রাইপুর গ্রামের বিজন বর্তমানে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। তার সংসারে ৫ জন লোক। তার অটোরিকশা তাকে দেখিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তাই তিনি প্রতিদিন সকালে তার অটোরিকশা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। আর গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন। এতে তার যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালান। মেহেরপুর সোনালী ব্যাংকের অফিসার শারীরিক প্রতিবন্ধী নাসির উদ্দিন জানালেন, তিনি অন্যদের দেখা-দেখি বর্তমানে তার থ্রি হুইলারে বৈদ্যুতিক মোটর লাগিয়েছেন। ব্যাংকে যাওয়া-আসা ছাড়া অন্যান্য কাজে যাতায়াত তার এখন সহজ হয়েছে। তারা আরো জানান, সাহস আর সহযোগীতা পেলে ভিক্ষাবৃত্তি নয় প্রতিবন্ধীরাও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত খেয়ে-পরে বাঁচতে পারেন। প্রতিবন্ধীরাও দেখতে পারেন সুন্দর স্বপ্ন আর গড়তে পারেন সুন্দর ভবিষ্যত।