বিশ্ব দেখুক, আমরা পারি

স্টাফ রিপোর্টার: সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতুর বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়েছে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং ও নদী শাসন কাজের উদ্বোধনের মাধ্যমে এ কর্মযজ্ঞ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এর মাধ্যমে শুরু হলো পদ্মা বহুমুখী সেতুর দৃশ্যমান নির্মাণের আনুষ্ঠানিক মহাকর্মযজ্ঞ। আগামী ৩৬ মাসের মধ্যে মোট ৪২টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে যাবে স্বপ্নের দ্বিতল পদ্মা সেতু। গতকাল শনিবার বেলা সোয়া ১১টায় শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতুর নদী শাসন এবং দুপুর ১টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল কাজের উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এ সময় সেতুটি নির্মাণে তার সরকারের মহা চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের ষড়যন্ত্রে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত। মিথ্যা অজুহাতে বিশ্বব্যাংক আমাদের অর্থ দেয়নি, কিন্তু আমরা বসে থাকিনি। বাঙালি জাতি বীরের জাতি, কারো কাছে মাথা নত করে না। আমরা নিজস্ব অর্থায়নেই এ সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চাই, কারো সাহায্য ছাড়াই পদ্মা বহুমুখী সেতুর মত যে কোন বৃহৎ প্রকল্প বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। বাংলাদেশের মানুষকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না, আমরা তা প্রমাণ করেছি। বিশ্ববাসী দেখুক আমাদের সক্ষমতা আছে, আমরাও পারি। বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে সকল অসাধ্য সাধন করতে পারে।
প্রসঙ্গত, দেশের ৪৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্পের নাম এই পদ্মা বহুমুখী সেতু। প্রায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য এই সেতু দিয়ে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সাথে সরাসরি সড়ক ও রেলপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের ২১ জেলা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল এই সেতু বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় প্রকল্প।
জাজিরায় সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সেতুটি নির্মাণে বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিলো। আজ মূল সেতুর নির্মাণ উদ্বোধন করতে এসে আমিও আবেগাপ্লুত। দেশবাসীর জন্য আজ একটি গৌরবের দিন, আনন্দের দিন। আমরা আশা করছি ২০১৮ সালের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এ সেতু দিয়ে যানবাহন এবং রেল চলাচল শুরু হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সেতুটি নির্মাণে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য দিতে এগিয়ে আসে। কিন্তু হঠাৎ করে ঘুষ গ্রহণের ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলো। আমরা যখন প্রমাণ চেয়ে বললাল যে টাকা পয়সার কোনো লেনদেনই হলো না, তাহলে ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি এলো কিভাবে? তারা বলল, প্রকল্পের সাথে জড়িতরা নাকি ঘুষ গ্রহণের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। আমরা প্রমাণ চাইলে বিশ্বব্যাংক দুটি কার্যাদেশের কাগজ দিলো। ওই কার্যাদেশটি আমাদের আমলে ছিলো না, সেটি ছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পদ্মার সেতুর বাইরে অন্য কাজের। কিন্তু তারা কোনো প্রমাণই দিতে পারেনি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কারোর নাম উল্লেখ না করে বলেন, আমাদের দেশে বিশ্বখ্যাত একজন ব্যক্তি রয়েছেন, যিনি দীর্ঘদিন অবৈধভাবে একটি ব্যাংকের এমডি পদে ছিলেন। এ কারণে তাকে সরিয়ে দিলে উনি সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। সেখানেও হেরে গিয়ে তাকে ওই ব্যাংকের এমডি পদটি ছাড়তে হয়। পরবর্তীতে উইকিলিকসের তথ্যেই বেরিয়ে আসে, ওই ব্যক্তি তার মেইল থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশকে অনুরোধ করে বলা হয় বাংলাদেশকে যেন সাহায্য না করা হয়। এরপরে তত্কালীন বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যান বোর্ডের কোনরূপ অনুমতি না নিয়েই অন্যায়ভাবে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণাঞ্চলকে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যরা সবাই অবহেলার চোখে দেখেছে। আমরা দক্ষিণাঞ্চলে নতুন পোর্ট করেছি, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছি। রেলওয়ের যোগাযোগও উন্নত হবে। তিনি বলেন, এ সেতু নির্মাণের ফলে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমরা মাওয়া ও জাজিরাকে ঘিরে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলব। আন্তর্জাতিকমানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে তোলা হবে। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী এ বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি দিয়ে সহযোগিতার জন্য মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এই এলাকার জনগণকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা জমি দিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ সেতু নির্মাণের সহযোগিতা করেছেন। সরকার আপনাদের পাশে আছে এবং থাকবে। আপনাদের যাতে কোনো রকম কষ্ট না হয় সে ব্যবস্থা আমরা করে দেব ইনশাআল্লাহ। আপনারা অচিরেই দেখতে পারবেন এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চেহারা পাল্টে গেছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ১৯৯৬ সালেই ক্ষমতায় এসে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। জাপান সফরে গিয়ে সেদেশের সরকারের কাছে রূপসা ও পদ্মা সেতু নির্মাণে সহযোগিতার অনুরোধ করি। জাপান সরকার তাতে রাজি হয়। মাওয়া পয়েন্ট দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য জাপানের উদ্যোগে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও শেষ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। এমনকি তারা মাওয়া থেকে পাটুরিয়াতে পদ্মা সেতু সরিয়ে নেয়ারও চক্রান্ত করে। শেষ পর্যন্ত কোনোকিছু না করে তারা পুরো প্রকল্পটিই পরিত্যক্ত করে। আসলে বিএনপি-জামায়াত জোট সন্ত্রাস-দুর্নীতি, জঙ্গিবাদের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়নে কোন কাজ করেনি। তারা সবদিক থেকে দেশকে অকার্যকর করে দেয়ার চেষ্টা করে গেছে। ঘন কুয়াশার কারণে এক ঘণ্টা বিলম্বে সকাল ১১টায় হেলিকপ্টারযোগে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবার সুধী সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছেই প্রথমে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা বহুমুখী সেতুর নদী শাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানস্থলে আসার আগেই পদ্মার এই পাড়ে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে সুধি সমাবেশটি রীতিমত বড় জনসভায় রূপ নেয়। শীত ও প্রবল ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে স্লোগান আর বাদ্য-বাজনার তালে তালে হাজার হাজার উত্ফুল্ল জনগণ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে সেখানে উপস্থিত হন। মূল প্যান্ডেলে স্থান সাংকুলান না হওয়ায় বাইরের চতুর্দিকে থাকা হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যাতে শুনতে পারে সেজন্য স্থাপন করা হয় বেশ কয়েকটি বিশাল ডিজিটাল স্ক্রিনের। জাজিরার নাওডোবা পয়েন্টে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্থানীয় সংসদ সদস্য বিএম মোজাম্মেল হক এবং সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। নদী শাসন কাজের উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী সেখান থেকে স্পিডবোটের মাধ্যমে পদ্মার মাওয়ার পাড় থেকে এক কিলোমিটার দূরে যান সেতুর ৭ নম্বর পিলারের স্থান পরিদর্শনে। সেখান থেকে মাওয়ায় ফিরে ৭ নম্বর পিলারের পাইল বসানোর কাজের ফলক শুভ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানেও একটি সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তিনি। দুটি প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন শেষে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার উত্তর মেদেনী মণ্ডল খানবাড়িতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় বক্তব্য প্রদান শেষে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকায় ফিরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, তারেক আহমেদ সিদ্দিক, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, কর্নেল (অব.) শওকত আলী, আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, হাবিবুর রহমান সিরাজ, একেএম এনামুল হক শামিম, পংকজ দেবনাথ, নাহিম রাজ্জাক এমপি, সাইফুর রহমান সোহাগ এবং মাওয়ায় সুধী সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা, কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, ক্রিকেটার গাজী আশরাফ লিপু, স্থানীয় এমপি অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমীন এমিলি, সুকুমার রঞ্জন ঘোষ প্রমুখ। উভয় অনুষ্ঠানেই সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকসহ সামরিক- বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।