স্টাফ রিপোর্টার: ‘আমি বাবার সাথে স্কুলে যাবো। মা আমাকে আইসক্রিম কিনে দেয় না। মায়ের পয়সা নেই।’ হৃদি হোসেনের কচি হৃদয়ের বুকচাপা বেদনা এভাবেই কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। নিখোঁজ পারভেজ হোসেনের মেয়ে হৃদি এখন একটি কিন্ডারগার্টেনে নার্সারি শ্রেণিতে পড়ছে। গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর প্রেসক্লাবে সন্তানহারা নিখোঁজ ১৯ পরিবারের সদস্যদের আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলনে মাইকের সামনে হৃদি বলে যাচ্ছিলো তার সব কষ্টের কথা। নিখোঁজ বাবার জন্য তার চোখে ঝরছিলো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। তার এ কান্না উপস্থিত সবাইকে বেদনার্ত করে তোলে। অনেকেই কেঁদে ফেলেন ঝরঝর করে।
নিখোঁজ হওয়া ১৯ যুবকের স্বজনেরা এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই ১৯ জনের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানা গেছে যারা রাজধানীতে থাকতেন। এসব নিখোঁজ মানুষের স্বজনরা বলে যাচ্ছিলেন প্রিয়জনকে হঠাত করে হারিয়ে ফেলার কষ্ট, দুর্দশা আর নানা দুর্ভোগের কথা। তাদেরই একজন ছোট্ট হৃদি। তার এক মুখে যেন শত মানুষের স্বজন হারানোর কষ্ট মূর্ত হয়ে ওঠে। হৃদি বলে, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও। আমি বাবার সাথে স্কুলে যাব। মা আমাকে আইসক্রিম কিনে দেয় না। মায়ের পয়সা নেই। বাবা আইসক্রিম কিনে দেবে শিশুপার্কে নিয়ে যাবে। বাবাকে অনেক দিন দেখি না। নিখোঁজ অপর ব্যক্তি রাজধানীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমনের মা হাজেরা খাতুন সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। সন্তানহারা ১৯ পরিবারের কান্নাকাটি ও আহাজারির মধ্যেই তিনি সবার সন্তান ফিরে পাওয়ার আকুতি জানান। সংবাদ সম্মেলনে সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন মুনি্ন বলেন, প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের কান্না শুনবেন না। আমরা আমাদের ভাইকে ফেরত চাই না। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, আমাদের পরিবারের সবাইকে মেরে যান। আমরা আর কাঁদতে চাই না। কাঁদতে কাঁদতে আমাদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। গত ২০১৩ সালে ৬ ডিসেম্বর গুম হওয়া নিজাম উদ্দিন মুন্নার বাবা সামছুদ্দিন বলেন, আমার একটাই পরিচয় গুম হওয়া সন্তানের পিতা। এই পরিচয় আর কারো হোক তা কামনা করি না। অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে চাই না। সরকারের কাছে একটা চাওয়া- আমাদের সন্তানকে মেরে যেখানে রাখা হয়েছে সেই মাটিটা আমাকে দেখিয়ে দিন। যেন মাটিটা ছুঁয়ে সান্ত্বনা পেতে পারি। জিয়ারত করতে পারি।
গত ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন বলেন, ২ বছর পার করেছি, আর পারছি না। সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনারা ভালো করে লিখবেন যেন আমাদের সন্তানদের ফেরত পাই। এ কথা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠেন। পরে আর তিনি কথা বলতে পারেননি। গত ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর গুম হওয়া খালিদ হাসান সোহেলের স্ত্রী শাম্মী সুলতানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, জেলগেট থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। এখনো ফেরত পাইনি। আমার দুই বছরের সন্তান পিতা ছাড়া শৈশব পার করেছে। আমার সন্তানের সেই শৈশব ফিরিয়ে দিন। একই বছরের ২ ডিসেম্বর গুম হওয়া সোহেলের ছেলে জেএসসি পরীক্ষার্থী রাজু বলে, বাবা আমার জন্মদিনের ফুল কিনতে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেননি। বাবা ছাড়া আমাদের ভবিষ্যত অচল। বাবাকে ফিরিয়ে দিন। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর গুম হওয়া আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমীন বলেন, রাত ২টার দিকে পোশাকধারী ৱ্যাব-১ পরিচয়ে আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে যায়। তারা আমার ছেলেকে ফেরত দিয়ে যাবে বলেছিলো। আজো ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন- প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে প্রশাসন আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেবে।
২০১৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রাজধানীতে গুম হওয়া ১৯ জন হলেন- সাজেদুল ইসলাম সুমন, জাহিদুল করিম তানভীর, আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আসাদুজ্জামান রানা, আল আমিন, এমএ আদনান, কাউসার, সেলিম রেজা পিন্টু, খালিদ হাসান সোহেল, সম্রাট মোল্লা, জহিরুল ইসলাম, পারভেজ হোসেন, মো. সোহেল, মো. সোহেল চঞ্চল, নিজাম উদ্দিন মুন্না, তরিকুল ইসলাম ঝন্টু, মাহবুব হাসান সুজন ও কাজী ফরহাদ।