অনুকরণীয় এক মহান পুরুষ ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

আজ ৫ ডিসেম্বর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকী। বরেণ্য এই নেতা ১৯৬৩ সালের এই দিনে লেবাননের বৈরুতে একটি হোটেলকক্ষে মৃত্যুবরণ করেন। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বাঙালি এই রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অভিজাত ও ঐতিহ্যমণ্ডিত পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি জনসেবামূলক রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সারিতে শামিল হন এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীকে পরিণত হন। ক্ষমতার মোহ কখনও তাকে তার আরাধ্য জীবন দর্শন ও আদর্শ হতে বিচ্যুত করতে পারেনি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দাঙ্গা-পীড়িত কোলকাতা শহরে থেকে যান তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য। এ সময় আর্ত মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সাথে যে শান্তি মিশন পরিচালনা করেন, একদিন না একদিন ইতিহাস তার সঠিক মূল্যায়ন করবে নিশ্চয়ই। জনগণের রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবরণসহ তাকে কয়েকবার হত্যারও চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তান আমলে তাকে রাজনীতি হতে উচ্ছেদ করা ও নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা ইত্যাদি সবই ছিলো তত্কালীন স্বৈরশাসকদের জঘন্য ষড়যন্ত্র ও অপরাজনীতির ফল। নির্বাসনে হতোদ্যম জীবনের এক পর্যায়ে তার নিঃসঙ্গ মৃত্যু হলেও এখনও তিনি গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের অন্তরে সমুজ্জ্বল ও স্থায়ী আসনে সমাসীন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিলো। আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়ন এবং স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালির যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, তিনি ছিলেন তার অন্যতম রূপকার। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ব্যাপক জয়লাভ করে। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কও। তার প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। এ সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতারোহনের পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যাতে বাঙালি দেখতে পায় আশার আলো। এতে তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ও কায়েমি স্বার্থের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। তবে তিনি শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও জনমতের প্রতি ছিলেন আজীবন শ্রদ্ধাশীল ও একনিষ্ঠ। তাই সুধী সমাজ তাকে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতে, ‘যে জাতি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে না, সেই জাতি আসলে নিজেকেও রক্ষা করতে পারে না।’ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থায়িত্ব নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর অবাধ গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণের সুযোগ দেয়া, অক্ষরে অক্ষরে শাসনতন্ত্র বা সংবিধান মেনে চলা ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা।’ তার ভাষায়, রাজনীতি একটি শক্তিশালী অস্ত্র এর ন্যায্য উদ্দেশ্য ও সম্মানজনক লক্ষ্য সাধনের জন্য সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক ও বিশেষভাবে অনুসরণীয়। তিনি অনুকরণীয় এক মহান পুরুষ।