বগুড়ার শিবগঞ্জ শিয়া মসজিদে গুলি : আটক ২

স্টাফ রিপোর্টার: বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার চককানু গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের হরিপুর আল-মোস্তফা জামে মসজিদে বন্দুকধারীদের গুলিতে মোয়াজ্জিন নিহত এবং অপর তিনজন মুসল্লি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় পুলিশ সাবেক এক জেএমবি সংগঠকসহ দুজনকে আটক করেছে। যদিও এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। গোটা এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গতকাল সিয়া মসজিদে জুম্মার নামাজ হয়নি। এদিকে গত বৃহস্পতিবারের ঘটনায় হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং ঘটনাস্থল আল মোস্তফা জামে মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ সোনা মিয়া শিবগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা ৩ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ ঘটনার কারণ অনুসন্ধানসহ জড়িতদের চিহ্নিত করতে দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। এরা হচ্ছে শিবগঞ্জ থানার কিচক ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান ওরফে মান্নান কসাইয়ের ছেলে জুয়েল মিয়া (২৫) ও মাঝিহট্ট ইউনিয়নের মৃত তোজাম্মেল হোসেনের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৪৮)। এর মধ্যে আনোয়ার হোসেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র স্থানীয় সংগঠক ছিলেন। সন্দেহের তীর নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়েতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর দিকে রেখেই তদন্ত চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুলছে না জেলা পুলিশ।
তবে স্থানীয় শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন অভিযোগ করেছেন পরিকল্পিতভাবে ত্রাস ছড়ানোর জন্যই ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আটককৃতদের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে ঘটনার পর থেকে ওই এলাকায় চিরুনি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এখনও পুরো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শিয়া সম্প্রদায়ের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মসজিদের ভেতরে এ ধরনের হামলার ঘটনায় স্তম্ভিত স্থানীয় সুন্নি মুসলমানরাও। ইসলামের অনুসারী উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ঘটনাটিকে দেখছেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, গুলিবিদ্ধ শিয়া মসজিদের ইমাম বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন মাও. শাহিনুর জানান, দুর্বৃত্তরা গুলি করার পর মসজিদের গেটে তালা লাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন গিয়ে তালা ভেঙে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ৪ জনকে উদ্ধার করে। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন আলী আহম্মদ (৭০)। বৃহস্পতিবার মসজিদে হামলার সময়ও তিনি মসজিদের ভেতরে ছিলেন। তিনি জানান, অন্যান্য দিনের মতো নামাজ আদায়ের জন্য তিনি মসজিদে যান। মসজিদে ঈমামসহ ১৩ জন মুসল্লি ছিলেন। তিন যুবক মসজিদে ঢুকে প্রথমে গ্রিলের দরজাটি বন্ধ করে দেয়। এরপর মসজিদের প্রধান দরজা থেকে গুলি বর্ষণ করে। পরে তারা মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে অজুখানার পাঁচিল টপকে মাঠের মধ্য দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পিলারের আড়ালে থাকার কারণেই তিনি প্রাণে বেঁচে যান বলে জানান। এ সময় উপস্থিত মুসল্লিরা প্রাণভয়ে চিত্কার করতে থাকেন। ধর্মীয় বিষয়ে স্থানীয় কারো সাথে কোনো ধরনের বিরোধ আছে কি-না জানতে চাইলে আলী আহম্মদ বলেন, ‘এ ধরনের কোনো বিরোধ এখানে নেই। সবাই মিলেমিশে থাকি। এলাকার কোনো মানুষ এ ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস হয় না।’ মসজিদের জায়গা নিয়ে স্থানীয় এক ব্যক্তির সাথে বেশ কিছুদিন যাবত মামলা চলছে বলেও জানান তিনি। মসজিদের পাশের বাসিন্দা আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সাবিনা আকতার বলেন, ওই তিন যুবক আছরের নামাজের সময় থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে মসজিদের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিলো। সন্ধ্যার আগেও তাদেরকে মসজিদের পেছনের মাঠে গল্প করতে দেখা গেছে। মসজিদে গুলি করে দৌড়ে পালানোর সময় মহিলারা ধর ধর বলে চিত্কার করলেও কোনো পুরুষ মানুষ না থাকায় তাদেরকে ধরা যায়নি।
স্থানীয়রা যা বললেন, হরিপুর গ্রামের শিয়া সম্প্রদায়ের আব্দুস সামাদ, হুমায়ন আলী, মেহেদি হাসান, রবিউল ইসলাম সকলেই জানান, এলাকার ৮টি গ্রামে বসবাসকারী মুসলিমদের মধ্যে দুই দশক আগ পর্যন্ত শতভাগই সুন্নি সম্প্রদায়ের অনুসারী ছিলেন। তবে প্রায় ১৫/১৬ বছর আগে তাদের কয়েকজন শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী হন। এরপর ক্রমান্বয়ে শিয়া অনুসারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে ১১০টি পরিবারের প্রায় ৫০০ মানুষ শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী হয়েছেন। এরমধ্যে হরিপুরেই প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার রয়েছে। পাশের বেলাই গ্রামেও শিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদ রয়েছে। তবে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব কিংবা সংঘাত ছিলো না।
এদিকে এ ঘটনার পর থেকে শুধু হরিপুরে নয়, জেলার ৭টি স্থানে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে দাবি করেছেন শিয়া সম্প্রদায় পরিচালিত আল মাহাদি শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক মাওলানা মোজাফফর হোসেন। এ ব্যাপারে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল জানান, হরিপুর এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও যথাযথ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে।
মসজিদ দেখতে ভিড়, মসজিদে গুলি বর্ষণের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর শুক্রবার ভোর থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের এই মসজিদটি দেখার জন্য আশপাশের এলাকা থেকে দলে দলে নারী-পুরুষ হরিপুরে ছুটে আসছেন। সেই সাথে পুলিশ, ৱ্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য এই এলাকায় অবস্থান করছে। গতকাল শুক্রবার ওই মসজিদে জুম্মার নামাজ হয়নি।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই মসজিদে দুর্বৃত্তদের গুলিতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত এবং ইমামসহ ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়। আহতদের মধ্যে দুজন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

Leave a comment