স্টাফ রিপোর্টার: যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রিভিউ খারিজের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপিতে স্বাক্ষর করেন আপিল বিভাগের চার বিচারপতি। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সেটি পাঠানো হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সেখান থেকে রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে রায়ের কপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছানো হয়। রাত ১০টার দিকে দু আসামিকে রায়ের কপি পড়ে শোনানো হয়। সুপ্রিমকোর্ট ও ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিস এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে দু আসামি-বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের সাথে দেখা করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। পাশাপাশি দেখা করার আবেদন করেছেন মুজাহিদের পাঁচ আইনজীবী। কারাগারে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে ফাঁসির মঞ্চ। এছাড়া যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে ছয়জন জল্লাদকে। তৈরি রাখা হয়েছে ফাঁসির রশি। আর রায় কার্যকরকে সামনে রেখে কারাগার ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়। নাজিমউদ্দিন রোডের প্রবেশমুখ চানখাঁরপুল থেকে চকবাজার পর্যন্ত রাস্তায় সকাল থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে সন্ধ্যায় খুলে দেয়া হয়েছে। কারাগারের চারপাশে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ, ৱ্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। নগরীর অন্যান্য স্থানেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কারা সূত্র জানায়, রায় বাস্তবায়নের বিষয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জরুরি বৈঠকে বসেন কারা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সেখানে আইজি প্রিজনের সভাপতিত্বে কারা অধিদফতর ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রায় কার্যকরের প্রস্তুতির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বিচারকদের স্বাক্ষরের পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদন খারিজের রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ের কপি ট্রাইব্যুনালে পৌঁছানোর পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায় স্বাক্ষর শেষে তা ট্রাইব্যুনালে পৌঁছেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দণ্ডিতরা এখন যদি প্রাণভিক্ষা চান, শুধু সেটাই এখন বিবেচনায় নেয়া হবে। এছাড়া আর কিছুই করার নেই।’ তবে প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই বলেও উল্লেখ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
বুধবার দু আসামির রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ। বেঞ্চের অপর সদস্যরা ছিলেন-বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বৃহস্পতিবার সকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রিভিউ খারিজের সংক্ষিপ্ত রায়ের কপি চেয়ে আপিল বিভাগের কাছে মৌখিক আবেদন জানায়। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, সংক্ষিপ্ত রায়ের কপির প্রয়োজন হবে না। এদিন সন্ধ্যায় চার বিচারপতিই রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণভ চক্রবর্তীসহ কয়েক কর্মকর্তা রিভিউ খারিজের রায়টি ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যান। ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মাইক্রোবাসে (ঢাকা মেট্রো চ ৫৩-৮১২১) রাত পৌনে ৯টায় ট্রাইব্যুনালের ৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী কারাগারে যান। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার আফতাবুজ্জামান। তার সাথে ছিলেন- ট্রাইব্যুনালের আইন ও গবেষণা কর্মকর্তা ফাহিম ফয়সাল, লাইব্রেরিয়ান তাপস চন্দ্র রায়, ট্রাইব্যুনালের স্টাফ জহুরুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম। কারাগার থেকে বের হয়ে কারা ফটকে তাদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, রায়ের দুটি কপি কারাগারে এবং দুটি কপি জেলা প্রশাসকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
কারাগার সূত্র জানায়, নিয়ম অনুসারে ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় উপস্থিত থাকবেন কারা অধিদফতরের কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ফজলুল কবীর, উপ-কারা মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, কারাধ্যক্ষ (জেলার) নেসার আলম, ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিঞা, ডিএমপি কমিশনারের প্রতিনিধি, লালবাগ জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. মালেক মৃধা, কারাগারের চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
প্রস্তুত ফাঁসির মঞ্চ: কারা সূত্রে জানা গেছে কারাগারের পূর্ব-পশ্চিম কোণে ফাঁসির মূলমঞ্চ। এর দৈর্ঘ্য আট ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে চার ফুট। গত ১১ এপ্রিল রাত ১০টায় এই মঞ্চেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামান ও ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কারা কর্মকর্তারা জানান, এ মঞ্চটি ভূমি থেকে উঁচুতে এবং পাশাপাশি দু’জনের ফাঁসি কার্যকর করার ব্যবস্থা আছে। মঞ্চের ওপরে যে ফাঁসির কাষ্ঠ তার উচ্চতা আট ফুট। আর মঞ্চ থেকে নিচের দিকে বারো ফুট গভীর গর্ত আছে। সেই গর্ত কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। ফাঁসি কার্যকরের জন্য দক্ষিণে রাখা হয়েছে একটি লম্বা টেবিল, যাতে পাশাপাশি ১০ জন বসতে পারেন। তার সামনে আরেকটি টেবিলও রাখা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর করার পর ফাঁসকূপ থেকে লাশ তুলে মরদেহ ওই টেবিলে রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। পুরো ফাঁসির মঞ্চে লাল ও সবুজ রঙের শামিয়ানা টানিয়ে দেয়া হয়েছে। যাতে বাইরে থেকে ফাঁসির মঞ্চ দেখা না যায়। দু আসামির ফাঁসি একই সাথে কার্যকরের সুযোগ আছে কি-না জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারাগারের এক ডেপুটি জেল সুপার জানান, দু’জনই শুধু নয়, এক রাতে পাঁচজন বা তারও বেশি আসামির রায় কার্যকরের অভিজ্ঞতা কারা কর্তৃপক্ষের আছে। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনের ফাঁসি একযোগে কার্যকর করা হয়েছিলো। তাই দুআসামির রায় একযোগে কার্যকর করার মতো পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সক্ষমতা কারা কর্তৃপক্ষের আছে।
প্রস্তুত ছয় জল্লাদ: কারাগারের জল্লাদ রাজুর নেতৃত্বে ছয় জল্লাদকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। দুটি রায় একই সাথে কার্যকর করা হলে প্রয়োজনে জল্লাদের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ছয় জল্লাদের অন্যরা হলো জল্লাদ রানা, ফল্টু, শামসু, জনি ও ফারুক। তবে শেষ মুহূর্তে জল্লাদের নামে পরিবর্তন হতে পারে। জল্লাদের সংখ্যা কমানো বা বাড়ানো হতে পারে। তাছাড়া প্রধান জল্লাদের দায়িত্বেও পরিবর্তন আসতে পারে।