সারারাত স্ত্রীর কবরে কাটিয়ে ভোরে বাড়ি ফিরে খুনি খোঁজে পানের বাটা

স্টাফ রিপোর্টার: স্ত্রী আলেয়াকে খুনের পর সারাদিন মাঠে আত্মগোপন করলেও সন্ধ্যার পর স্ত্রীর কবরে পৌঁছায়। রাতের অধিকাংশ সময় সেখানেই ছিলো খুনি আব্দুর রহমান ওরফে রহম আলী (৫০)। স্ত্রী আলেয়া খাতুনকে জবাই করে আত্মগোপনের ২৪ ঘণ্টার মাথায় গতকাল সোমবার ভোরের আলো ছড়াতেই গ্রামের বেশ কয়েকজনের সাথে দেখা হয়। কৌতুহলী গ্রামবাসীর এ প্রশ্নের জবাবে রহম আলী তথ্য দিয়ে বলেন, ভোরে পান খাওয়ার জন্য বাড়িতেও গিয়েছিলাম। পানের বাটা খুঁজে না পেয়ে পুকুরপাড়ের কাঁঠালগাছে উঠে বসেছিলাম।
রহম আলীর এসব কথা শুনে গ্রামের কয়েকজন সচেতন ব্যক্তি কৌশলে তাকে তারই বাড়িতে নিয়ে বসিয়ে রাখে। খবর দেয় পুলিশে। সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার এসআই রহম আলী সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে রহম আলীকে গ্রেফতার করেন। পুলিশ অবশ্য বলেছেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সকাল ৯টার দিকে রহমকে তার বোনের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর সে তার স্ত্রী আলেয়া খাতুনকে জবাই করে আত্মগোপনের কথা স্বীকার করে বলেছে, রাতে ঝগড়ার পর ঘুমিয়ে গেলে সুযোগ বুঝে দা দিয়ে কয়েকটি কোপ মেরে স্ত্রীকে মেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই।
কেন ঝগড়া? কেন খুন? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের পদ্মবিলা ইউনিয়নের গোপিনাথপুরের খুনি রহম আলী বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার দিগড়ীর এক যুবকের সাথে পরকীয়া প্রেম। এ থেকে স্ত্রীকে ফেরানোর জন্য শত চেষ্টা করেও পারিনি। সে কারণেই মাথায় খুন চেপে যায়। দা দিয়ে কুপিয়েই জবাই করে সরে পড়ি। তবে খুনের পর মনে হয়েছে ভুল হয়ে গেছে। তাই মাগরিবের নামাজের পর যখন দাফন করা হয় তখন দূরে দাঁড়িয়ে দেখি। লোকজন সরে গেলে কবরে গিয়ে মাটি দিয়ে বসে থাকি। রাতের অধিকাংশ সময়ই কবরস্থানে কেটেছে। পুলিশের কাছে এসব স্বীকারোক্তি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানালেও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মহাসিন বলতে পারেননি, ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট রহম আলী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে কি-না। তবে গতকালই তাকে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন বিজ্ঞ আদালত। এদিকে খুনি রহম আলীকে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় হলেও ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মাথায় গ্রেফতার করতে সক্ষম হওয়ায় পুলিশকে অনেকেই অভিনন্দন জানালেও খুনে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রটি খুনির স্বীকারোক্তিতে উদ্ধার করতে না পারায় মামলার তদন্তকারী কর্তার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
দীর্ঘ প্রায় দু যুগের সংসার ছিলো রহম আলী-আলেয়া খাতুন দম্পতির। আলেয়া খাতুনের রহম আলী ছিলো দ্বিতীয় স্বামী আর রহম আলী ছিলো ৪র্থ। রহম আলী প্রথম স্ত্রীকে বাপের বাড়ি রেখে নিজ গ্রামে যুবতীর ঘরে ঢুকে ধরা পড়ে। পড়শিরা ধরে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। প্রথম স্ত্রী রহম আলীর সংসার ছেড়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও দ্বিতীয় স্ত্রী রেশপতিকে নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হয়। বিয়ের দু বছরের মাথায় ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়। প্রথমে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা হলেও পরে অবশ্য প্রমাণিত হয় সেটা ছিলো হত্যা। এ মামলায় প্রায় তিন বছর রহম আলীকে হাজতবাসও করতে হয়েছে। হাজত থেকে ফিরে নিজ গ্রামে তৃতীয় বিয়ে করে। সে স্ত্রী পড়ে নির্যাতনের মুখে। দু সন্তানের জননী হলেও স্বামী রহমের সংসার ত্যাগ করে। এরপর রহম আলী পাশ্ববর্তী নিমতলার মেয়ে আলেয়া খাতুনকে পরকীয়ায় ভুলিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে নতুন সংসার পাতে। আলেয়া খাতুনের বিয়ে হয়েছিলো নিমতলা গ্রামেই। বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় ফিরিনির সময় স্বামী হাকিমকে পিতার বাড়ি রেখেই আলেয়া খাতুন পাড়ি জমায় রহমের বাড়িতে। কিছুদিন পরই শুরু হয় নির্যাতন। ফেরার পথ পাননি আলেয়া খাতুন। প্রায় ২৪ বছর ধরে সংসার করলেও রহমের মন থেকে স্ত্রীর প্রতি পরকীয়ার সন্দেহের ঘুণ পিছু ছাড়েনি। সংসারে ৪ সন্তান এলেও নির্যাতন ছিলো নিত্যদিনের ব্যাপার। যেদিন গাঁজা সেবন করে বাড়ি ফিরতো সেদিন মারপিট ছিলো অবধারিত। নির্যাতনের অজুহাত একটাই, পর পুরুষের সাথে গোপন সম্পর্ক করা। দীর্ঘ দু যুগ ধরে একই অভিযোগ করে এলেও রহম আলী কাউকেই তার স্ত্রীর সাথে ঘরে বা বাইরে অবস্থান করাকালে হাতেনাতে ধরতে পারেনি। স্থানীয়রা এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, মৃত আবু তালেব মণ্ডল কচুয়ানের ১০ ছেলে-মেয়ের মধ্যে তৃতীয় রহম আলীর পরের বাড়ি রাখালের কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও পরবর্তীতে শুরু করে মোষ পেলে দুধ বিক্রি। সাপুড়েও সেজেছে কিছুদিন। এরপর ওই স্ত্রী আলেয়ার বাপের বাড়ির জমি বিক্রির টাকা নিয়ে বাড়িতে রাইসমিল দিয়ে শুরু করে ফুটুনি।
উল্লেখ্য, গত পরশু রোববার রাতে ঘরে চৌকির ওপর ঘুমিয়ে ছিলো দু মেয়ে। নিচে বিছানায় শুয়েছিলো রহম আলী ও তার স্ত্রী আলেয়া। পরকীয়ার অভিযোগ তুলে শুরু হয় ঝগড়া। আর কতোদিন তুমি মিথ্যা অভিযোগ তুলে মারধর করবা? ঝগড়ার মধ্যে আলেয়া এ প্রশ্নও করে স্বামীকে। খুন করেই থামবো। সত্যিই ঘুমিয়ে গেলে জবাই করবে পাশে থাকা চরম বিশ্বাসের পুরুষ মানুষরূপী পশু তা বুঝতেই পারেননি আলেয়া খাতুন। অবাক হলেও সত্য যে, যখন স্ত্রীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জবাই করে তখন একই ঘরে থাকা দু মেয়ে দেখেও প্রাণ ভয়ে কুকড়ে যায়। খুনের পর রহম দিব্যি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বাইরে থেকে দরজায় শিকল তুলে সটকে পড়ে। সে গ্রামেরই আশেপাশে আত্মগোপনে ছিলো তা টের পায়নি গ্রামের তেমন কেউ। দাফনের রাত পোয়াতে না পোয়াতে রহমকে গ্রেফতার করায় আতঙ্ক গ্রস্থ দু কন্যার মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।