চাঞ্চল্যকর তথ্য নূর হোসেনের

স্টাফ রিপোর্টার: নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বলেছেন। কার নির্দেশে, কিভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে তার বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সবিস্তারে ঘটনা খুলে বলেন।

নূর হোসেনকে এই জিজ্ঞাসাবাদের পুরো সময়টির ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়। ভিডিও রেকর্ডটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র। এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে নূর হোসেনকে ভারতীয় প্রতিনিধি দল বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে আসে। সেখানে অপেক্ষমাণ নারায়ণগঞ্জ পুলিশের প্রতিনিধিরা নূর হোসেনকে গ্রহণ করতে চাইলেও তাদের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি ভারতীয় প্রতিনিধি দল। ভারতীয় কর্মকর্তারা জানতে চান, র‌্যাবের কোনো প্রতিনিধি এখানে উপস্থিত আছেন কি-না। এ সময় র‌্যাবের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান এগিয়ে গেলে তার কাছে নূর হোসেনকে হস্তান্তর করা হয়। এরপর কড়া নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে র‌্যাবের একটি দল তাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দেয়।

এ প্রসাথে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ঘটনার পর র্যাব সদর দফতরের কিছু কর্মকর্তাকে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়ানোর অপচেষ্টা করা হয়েছিলো। তাই শুরু থেকেই নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার জন্য র্যাব সদর দফতর বিশেষভাবে তৎপর ছিলো। এ জন্য ভারতীয় পক্ষের সাথে এ বিষয়ে র্যাব আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ করে আসছিলো। মূলত এ কারণেই ভারতীয় প্রতিনিধি দল নূর হোসেনকে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করেছে। কিন্তু যেহেতু মামলার তদন্ত কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। তাই র্যাব নিরাপদে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে ঘটনার সাথে ব্যক্তিগতভাবে তাকেও জড়িয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা বলা হয়েছে। তাই তিনিও ব্যক্তিগতভাবে নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। যাতে করে প্রকৃত ঘটনা দেশবাসী জানতে পারেন।

সূত্র জানায়, নূর হোসেনকে গ্রহণ করার পর ঢাকায় ফেরার পথে তাকে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় নূর হোসেন দাবি করেন, এ হত্যাকাণ্ডে তিনি মূলত ব্যবহৃত হয়েছেন। তার ঘাড়ে বন্দুক রেখে উদ্দেশ্য হাসিল করেছে একটি বিশেষ পক্ষ। হত্যা পরিকল্পনার নেপথ্যের ব্যক্তি হিসেবে তিনি একজন বিশেষ ব্যক্তির নামও বলেন। তবে বিচারাধীন বিষয় হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রটি ওই পরিকল্পনাকারীর নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি।

সূত্র বলছে, নেপথ্যের ওই পরিকল্পনাকারী মূলত এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে চেয়েছিলেন। প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামকে সরিয়ে দিতে তিনি নূর হোসেনকে ব্যবহার করেন। নূর হোসেন র্যাবকে ব্যবহার করে এই কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেন। হত্যাকাণ্ডে ছয় কোটি টাকার ব্যবহার প্রসঙ্গে নূর হোসেন জানান, এতো টাকা তিনি দেননি। হত্যাকাণ্ডের আগে অল্প কিছু টাকা তিনি র্যাব-১১’র এক কর্মকর্তাকে দিয়েছিলেন। কিলিং মিশন সফল হলে বাকি টাকা পরিশোধের কথা ছিলো। কিন্তু ঘটনার পর ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের কৌশল হিসেবে ছয় কোটি টাকার বিষয়টি নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যানকে দিয়ে বলানো হয়। অবশ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির কাছেও ছয় কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারেননি শহীদ চেয়ারম্যান। এ প্রসঙ্গে তিনি তদন্ত কমিটিকে বলেন, ‘ছয় কোটি টাকা দেয়ার কথা তিনি শুনেছেন।’ কার কাছ থেকে শুনেছেন জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় নূর হোসেন অকপটে স্বীকার করেন, নারায়ণগঞ্জের মাদকব্যবসার একচ্ছত্র আধিপত্য তার হাতেই ছিলো। মাদকব্যবসা থেকে তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করতেন। নির্বিঘ্নে মাদকব্যবসা করার জন্য স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকেও তিনি মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা দিয়ে ম্যানেজ করে রেখেছিলেন। বিশেষ করে র্যাব-১১’র তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল (বরখাস্তকৃত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কোম্পানি কমান্ডার মেজর আরিফ হোসেন ও স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার লে. কমান্ডার এমএম রানা তার কাছ থেকে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা করে মাসোয়ারা নিতেন।

নূর হোসেন জানান, ভারতের জেলে বন্দি থাকাবস্থায় বাংলাদেশ থেকে একজন বিশেষ ব্যক্তি তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এমনকি ভারতের দমদম কারাগারে গিয়ে তার সাথে একাধিকবার দেখাও করেন তিনি। তার পরামর্শেই নূর হোসেন বাংলাদেশে না ফেরার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদনও করেন। নূর হোসেন যাতে ভারতের কারাগারে আরাম-আয়েশে থাকতে পারেন এ জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে তার কাছে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকাও পাঠানো হতো।

সূত্র জানায়, তদন্তে সহায়তার অংশ হিসেবে দমদম কারাগারে সিসি ক্যমেরায় ধারণকৃত এ সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজও সরবরাহ করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কর্তৃপক্ষের কাছে এ সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর ভিডিও ফুটেজ সরবরাহ করা হবে।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে একটি নৃশংস ও বর্বরতম হত্যাকাণ্ড। কিন্তু ঘটনার পর র‌্যাবের কিছু কর্মকর্তাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য খুবই সূক্ষ্মভাবে এ কাজটি করে একটি বিশেষ মহল। তিনি বলেন, ঘৃণিত এ অপরাধের দায় বাহিনী হিসেবে র‌্যাবের নয়, এর দায় র্যাব-১১ তে কর্মরত কতিপয় লক্ষ্যভ্রষ্ট কর্মকর্তার। যাদেরকে এখন বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। র্যাব সব সময়ই চেয়েছে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সত্যটি বেরিয়ে আসুক। নূর হোসেন ফিরে আসার মধ্য দিয়ে ঘটনাটি এখন সত্য উন্মোচনের দ্বারপ্রান্তে।