স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা মানুষ পুড়িয়ে মারে, যাদের শরীরে মানুষ পোড়া গন্ধ, তাদের সাথে সংলাপে বসতে হবে। খুনিদের সাথে সংলাপে বসার কোনো ইচ্ছা নেই। জাতীয় সংলাপের জন্যই খালেদা জিয়া মানুষ হত্যা করে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া যখন স্বীকার করবেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত তখনই তিনি সংলাপে বসার যোগ্যতা অর্জন করবেন। লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জাতীয় সংলাপের আহ্বান নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এত দৈন্যদশায় বাংলাদেশ পড়েনি যে খুনিদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া হত্যা ও হামলার জন্য যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, আগুন দিয়ে মানুষকে হত্যার পরও যেখানে তারা কিছু করতে পারছে না, তাই একটি গ্রুপ নেমেছে গুপ্তহত্যায়। এ হত্যাকাণ্ডগুলো পরিকল্পিত। তা না হলে হত্যাকাণ্ড বন্ধে খালেদা জিয়া সংলাপের কথা বলছেন কেন? তিনি যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।
গতকাল রোববার সকালে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। সদ্য নেদারল্যান্ডস সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও লিখিত বক্তৃতার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে মূলত সাম্প্রতিক বিষয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে দু বিদেশি হত্যাকাণ্ড, হোসনি দালানে বোমা বিস্ফোরণ, পুলিশ হত্যাসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্রের বিষয় উঠে আসে। সংবাদ সম্মেলনটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো ব্যবহার করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া হত্যা ও হামলার পেছনে আইএস বা জঙ্গিগোষ্ঠী থাকার স্বীকারোক্তি দিতে প্রচণ্ড চাপ আসছে। তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চায়। তারা বাংলাদেশকে সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান বানাতে চায়। যে কোনো সময় হামলা চালাতে পারে। বাংলাদেশকে যে কোনোভাবে অনিরাপদ প্রমাণ করার জন্য আর্টিফিশিয়ালি এসব হত্যা-হামলা ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ মোটেই অনিরাপদ নয়, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ নিরাপদ।
নির্ধারিত সময় বেলা সাড়ে ১১টার কিছু পর (পাঁচ মিনিট) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনস্থল গণভবনের ব্যাঙ্কুয়েট হলে প্রবেশ করেন। ১৫ মিনিটে তিনি লিখিত বক্তৃতা পড়ে শোনান। সেখানে নেদ্যারল্যান্ডস সফরের বিষয় স্থান পায়। এরপর ১১টা ৫০ মিনিট থেকে ১২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন শেখ হাসিনা। এ সময় মঞ্চে তার সাথে ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে ব্যাঙ্কুয়েট হল ছাড়ার সময় সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তখন আরও কিছু সময় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। সফরের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রশংসা করেছেন এবং এ খাতে সহযোগিতার কথা বলেছেন।
সংলাপের আহবান প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে বিএনপি চেয়ারপারসনকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে ফোন করার কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, আপনারা জানেন, নির্বাচনের আগে আমি তাকে ফোন করি। তখন কী ধরনের কথা শুনতে হয়েছে। ফোন করে আমার ঝাড়ি খেতে হয়েছে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে গিয়েও প্রবেশ করতে না পারার কথাও মনে করিয়ে দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আপনি যদি কারও বাড়িতে যান, আর আপনার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়, আপনি কি তার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন? সংলাপের কথা বলার আগে খালেদা জিয়াকে মানুষ পোড়ানোর বন্ধ এবং জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বাংলাদেশকে যে কোনোভাবে অনিরাপদ আর (এখানে) জঙ্গি আছে স্বীকার করা, আর স্বীকার করলে হামলে পড়া- এ ধরনের পরিকল্পনা অনেকের আছে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হত্যা করছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে মারছে। সুতাটা কার হাতে? ক্রীড়নক কে? খেলছে কে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি দেশের ভেতর থেকেও বাংলাদেশকে অনিরাপদ প্রমাণ করার অপচেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারাই বাংলাদেশে আইএস আছে এটি প্রমাণ করতে চাইছে। আর তা প্রমাণ করা গেলে বাংলাদেশে কী ঘটতে পারে তা দেশবাসীকে অনুধাবন করতে বলেন তিনি। সিরিয়ায় কী হচ্ছে, লিবিয়ায় কী হচ্ছে, ইরাকে কী হচ্ছে সেসব দেশে যা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশেও সেই অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে ওই অবস্থা সৃষ্টি হোক তা তার সরকারের কাম্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী জানান, প্রচণ্ড চাপ যে আমরা কেন স্বীকার করি না। আমরা দেখতে পাচ্ছি কে, কারা এসব করছে। যারা ধরা পড়ছে, তারা একটি বিশেষ দলের সাথে সম্পৃক্ত, হয়তো ছাত্রজীবনে শিবির করেছে, নয়তো ছাত্রদল করেছে। আর কাউকে তো আমরা দেখছি না। বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখনই অনিরাপদ অনিরাপদ বলে চিৎকার করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জানান, তাদের আরও অনেক পরিকল্পনা আছে। তারা অনেকদূর এগোতে চায়। যারা বলছে, বাংলাদেশ নিরাপদ নয়, তাদের সাথে সুর মিলিয়ে অনেকে বাংলাদেশকে অনিরাপদ করতে চায়।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অনেক স্পষ্ট কথা বলছি। কারণ আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমি আমার বাবার (বঙ্গবন্ধুর) সন্তান। বাংলাদেশের নাগরিকদের অসাম্প্রদায়িক অভিহিত করে শেখ হাসিনা বলেন, আশুরার আগের রাতের বোমা হামলার ঘটনাকে শিয়া-সুন্নি গোলমাল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। এ ধরনের হামলা যারা চালিয়েছে এবং যারা এর পেছনে রয়েছে, তাদের অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থায়ন মূলত একটি দল করছে, আর মাঠে খুনখারাবির কাজ করছে আরেকটা দল। এর বেশ কিছু তথ্য আছে, আরও তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা হচ্ছে।
কোনো তদন্ত ছাড়াই এসব ঘটনাকে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হচ্ছে, কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের ষড়যন্ত্রের মধ্যে কি পা দেব পরিকল্পিত ঘটনা বলে? বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো কি বলবো? বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সহজ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকায় প্রতি মিনিটে কত ক্রাইম হচ্ছে? সে হিসাবে বলবো, বাংলাদেশ নিরাপদ। অনিরাপদ নয়।
বিএনপি-জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে নয়: আওয়ামী লীগ সভাপতি বিএনপি-জামায়াত থেকে কাউকে দলে না নেয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, যারা আমার দলে আসতে চায়, তাদের আমরা নেব না। তিনি দলীয় নেতাদের সতর্ক করে বলেন, তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আন্তঃদ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীকালে দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করে। তারা ভালো সেজে ঢুকেই হত্যায় লিপ্ত হয়। আর আওয়ামী লীগের লোক মারা গেলে তোর কারও কোন অসুবিধা নেই। কারও কোনো আফসোসও নেই।
ইন্টারনেট-অ্যাপে কড়াকড়ি আসতে পারে: জঙ্গিদের যোগাযোগ ও অর্থায়ন বন্ধে তাদের শনাক্ত করতে কিছু অ্যাপ বন্ধ করাসহ ইন্টারনেটের ওপর সাময়িক কড়াকড়ি আরোপের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মতে, ডিজিটালাইজেশনের শুভফল যেমন আছে, খারাপ ফলও আছে।
বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়: জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কথায় আছে- বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। সবাইকে সাহস রাখতে হবে। এ সময় ১৯৮১ সালে তার দেশে ফেরা ও প্রাণনাশের হুমকির কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সব তালিকার শীর্ষে রয়েছি আমি। আমি তো ভীত নই। নিজেরা সতর্ক-সাহসী না হলে চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু নিরাপত্তা দেয়া দরকার, সেটা দেয়া হচ্ছে। যখনই যেখানে যা হচ্ছে, সাথে সাথে তা সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কম্বিং অপারেশন চলছে। এখন কোথাও যদি সন্ত্রাসীদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তবে তাদের ধরতে সাংবাদিকসহ সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। ধর্ম নিয়ে বিকৃত রুচির লেখালেখি না করার পরামর্শও দেন প্রধানমন্ত্রী।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মোটা অঙ্কের কিছু পেয়েছে: যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক বিবৃতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছি ও করব। তিনি বলেন, তাদের স্মরণ করা উচিত সাকা এবং মুজাহিদ কী অপরাধ করেছে। তারা নিশ্চয়ই মোটা অঙ্কের কিছু পেয়ে গেছে, এজন্য এসব মন্তব্য করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজও যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে ব্যবস্থাও নিতে হবে।