অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসবে আমজনতার দীর্ঘশ্বাস

কোন দিকে তাকাবেন? ডানে-বায়েঁ নাকি সামনে-পেছনে? ওপরে-নিচে? যেদিকেই দৃষ্টি দেবেন, সেদিকেই সমস্যার স্তূপ। অনিয়মে ভরা। সমাজের গোটা শরীর জুড়েই যেন দুর্নীতি নামের থকথকে ঘা। দেখেও না দেখার ভান। একদিকে ভাগ নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর, অন্যদিকে অজুহাত আর হতাশার দীর্ঘশ্বাস। এ থেকে মুক্তি মিলবে কবে? কবে থেকে শুরু হবে সমাজকে সুস্থ করে তোলার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা?
অবশ্যই কোনো সমাজ আপাদমস্তক একদিনে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়নি, হয় না। উদাসীনতা আর অন্যায়ের সাথে আপসের কারণে সংক্রমিত সমস্যা আর অনিয়ম ছড়িয়েছে সর্বত্র। পেয়েছে ব্যাপকতা। তা না হলে ট্রেনের টিকেট কাটতে গেলে শুনতে হয় ‘ফুরিয়ে গেছে’ গদবাধা বুলি। বেশি টাকা গুণলেই মেলে প্রত্যাশিত টিকেট। উপরি আয়ের এ ফাঁদ পাতার সাহস ওদের একদিনে সঞ্চিত নয়। আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের খাবার পরিবেশনে অনিয়ম তো বারোমেসে। রোগীর প্রাপ্য খাবার কম দেয়া মানে অন্যের মুখের খাবার কেড়ে খাওয়া। যে খায় তার নৈতিকতার স্খলন প্রাসঙ্গিক হলেও ভাগাভাগির বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক নয়। তা না হলে বরাদ্দকৃত মাংস গেলো কোথায়? রোগীর মাংস খেলো কে?
গতকাল দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় পৃথক দুটি প্রতিবেদনের একটিতে বলা হয়েছে, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ফিমেল সার্জারি ওয়ার্ডের ১৪ জন রোগীর একজনকেও বরাদ্দকৃত মাংসের এক টুকরোও দেয়া হয়নি। এক নারীরোগী প্রশ্ন তুলতেই তাকে শুনতে হয়েছে কড়া বকুনি। চোখ রাঙানিতো ছিলোই। অথচ চোখ রাঙানি করা সেবিকার উচিত ছিলো রোগীর প্রাপ্য খাবার হিস্যামতো খাবার সরবরাহের কাজে নিযুক্ত রাধুঁনী এবং বিতরণের কাজে নিয়োজিতদের নিকট থেকে আদায় করে দেয়া। তা হয়নি, উল্টো অভিযোগকারীকে শুনতে হয়েছে কটূক্তি। যেন মাসতুতো ভাই। এ অভিযোগ কি আবাসিক মেডিকেল অফিসার পর্যন্ত পৌঁছেছে? পাল্টা প্রশ্নও উঠতেই পারে অভিযোগ করেও কি প্রতিকার মেলে? মিলেছে?
অপর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের চুয়াডাঙ্গা স্টেশনের বুকিং সহকারী শিরিন শিলা। র‌্যাব’র ছদ্মবেশী তিন গোয়েন্দার হাতে ধরা পড়লেও ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন তিনিসহ তার সহযোগী স্টেশনের কম্পিউটার অপারেটর। অভিনব নয়, নির্ধারিত আসনযুক্ত টিকেট ফুরিয়ে গেছে অজুহাতে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ বেশ পুরোনো। পূর্বে ঈদ বকরিঈদে ভিড়ের মাঝে উপরি আয়ের জন্য এ ফাঁদ পাতা হলেও এখন প্রকাশ্যে প্রতিদিনই পাতা হয়। যাত্রী সাধারণকে অসহায়ের মতো অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হয়। চুয়াডাঙ্গা স্টেশনের চেয়ে আলমডাঙ্গা স্টেশনে হয়রানির মাত্রা অনেক বেশি। এ অভিযোগ তুলেও প্রতিকার নেই। আছে শুধুই হতাশার দীর্ঘশ্বাস।
কালক্রমে সমাজে সচেতনতার আলো ছড়াচ্ছে, বাড়ছে শিক্ষার হার। বৈদেশিক মুদ্রা প্রবৃদ্ধি ছাড়াও স্বল্প আবাদি জমিতে আবাদ করে কিভাবে খাদ্যে স্বনির্ভরতা আনতে হয় তাও দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের কৃষকেরা। অথচ অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কৃষকদেরই সুচিকিৎসা নিশ্চিত হচ্ছে না। ন্যায্য মাশুলে ট্রেন ভ্রমণের সুযোগ না পাওয়ার কারণে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। এর কুফল জাতিকেই ভোগ করতে হচ্ছে। যেহেতু বিষয়টি জাতিগত, সেহেতু সম্মিলিতভাবেই রুখে দাঁড়াতে হবে। গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে পূর্বের দায়িত্বশীলরা বর্তমানের ঘাড়ে যে বোঝা চাপিয়েছে, তা নামাতে এখনই জেগে উঠতে হবে। দায়িত্বশীলদের শুরু করা উচিত আজই। শুরু করতে হবে নিজের দফতর দিয়েই।
দুর্নীতি অনিয়ম সংক্রামক। উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ করতে পারলে প্রতিরোধ তথা সমাজকে পরিশুদ্ধ করা অসম্ভব নয়। তবে মনে রাখতে হবে দুর্নীতি রাস্তার পাশে জমে থাকা ময়লার স্তূপ নয়। মনের অন্দরে জমা ময়লা, যা মানসিকতায় পেয়ে বসা লোভ। ওটা তাড়িয়ে সুস্থ করা যার-তার দ্বারা সম্ভব নয়। দরকার সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার মতো নেতা। যার নেতৃত্বে সমাজ পাবে সুস্থতা, প্রজন্ম পাবে বাসযোগ্য প্রিয় মাতৃভূমি।