শুভবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার প্রতিটি মানুষই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে এখন কমবেশি উদ্বিগ্ন। এমন ধারণা যেন ক্রমশ বদ্ধমূল হতে চলেছে যে কোনো অপরাধ, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নয়, কেবল সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্যই যে কেউ যে কোনো সময়ে গুপ্তঘাতকের টার্গেট হতে পারেন। হামলার শিকার তারাই, যারা দেশকে ভালোবাসেন এবং সর্বক্ষণ সবার মঙ্গল কামনা করেন। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে অবস্থান নেবে এ প্রত্যাশা পোষণ করেই তারা নিজ নিজ অঙ্গনে সক্রিয়। অথচ এখন তাদের সবারই শঙ্কা আশপাশে নিষ্ঠুর ঘাতক ঘোরাফেরা করছে না তো? নাগরিক সমাজের এ ধরনের উৎকণ্ঠা দূর করার দায়িত্ব একান্তভাবেই রাষ্ট্রের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত শনিবারের সন্ত্রাসী ঘটনার চার দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তদন্তে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে হত্যাকাণ্ড এবং অপর একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে তিনজনকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মামলার আসামিরা ‘অজ্ঞাত পরিচয়’। দুটি মামলার তদন্তভার এখন ডিবির হাতে। তারা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে পারবে নাকি কেবলই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতাদের আশ্বাসবাণী শুনে যেতে হবে, এ প্রশ্ন নানা মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। দু বিদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই শনিবার রাজধানী ঢাকায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে। প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল এবং অপর দু প্রকাশক-লেখককেও হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। তারা বেঁচেছেন সৌভাগ্যক্রমে। কিন্তু আমাদের সমাজের অভ্যন্তরেই যে শ্বাপদ অপশক্তি সক্রিয় রয়েছে তাদের মোকাবেলার কৌশল রপ্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সে আস্থা মিলছে কোথায়? সন্দেহ নেই যে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিই ঘাতকদের লক্ষ্য। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার এবং রায় কার্যকরের সংকল্প থেকে সরকার যেন সরে আসে, সে অপচেষ্টাও একটি মহল করে যাচ্ছে। তাদের নিবৃত্ত করার জন্য সরকারের পাশাপাশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষকেও সক্রিয় হতে হবে। জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের ব্যানারে এক সময়ে ধর্মান্ধ অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। তাদের দমন করতেই হবে এ দাবি ধ্বনিত হয়েছিলো দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে। দলমত নির্বিশেষে সবাই ছিলো এ ইস্যুতে একাট্টা। এমন কথা বলা যাবে না যে, বাংলাদেশ বিপন্ন কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। ঘরে-বাইরে কারও নিরাপত্তা নেই, এমন বলাও হয়তো অনুচিত হবে। কিন্তু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একের পর এক সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও হত্যার চেষ্টা চালিয়ে জনমনে শঙ্কা-ভীতি সৃষ্টি করতে পেরেছে। কেবল গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়কে পুলিশি চেকপোস্ট বসানোই যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপিয়ে বক্তব্য রাখলেই জনমনে নিরাপত্তা বিষয়ে যাবতীয় উদ্বেগ দূর হবে, এমন ভাবারও কারণ নেই। সরকারকে প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের দ্রুততম সময়ে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করতে হবে। কেবল এভাবেই দেশবাসী আশ্বস্ত হবে, জনমনে আস্থা ফিরবে এবং বিদেশিদের কারও কারও মনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে তা দূর হবে।